অতনু কি ভুলে যাবে কাকে বলে অসঙ্গত, আর কাকে বলে অসামাজিক?
কিন্তু কি করে ভুলবে?
দরজায় যে ছায়া পড়েছে।
দীর্ঘছায়া। সাড়ে তিন হাত মানুষের ছায়া কি চৌদ্দ হাত? একুশ হাত? একশো হাত?
ছায়ার ভিতরে কিছু নেই, অসার বলেই নিজেকে এত বাড়িয়ে তুলতে পারে?
তাই সামান্য একটা সাড়ে তিনহাত মাপের মানুষের ছায়ায় লুপ্ত হয়ে যায় জগতের সমস্ত মমতা, সমস্ত করুণা, সমস্ত প্রেম! লুপ্ত না হলে কেমন করে অমন চেঁচিয়ে উঠল অতনু?
ফের? ফের ওই রকম মিথ্যে মিথ্যে পাগলামী হচ্ছে? কী বললাম এতক্ষণ? ভাবো! মনের জোর দিয়ে ভাববা–আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আমি ভালো আছি।
দরজার ছায়া ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। একটা নয় দুটো।
অতনু পাখী পড়াচ্ছে।
কই বললে না? বল, আমি ভাল আছি। আমি ঠিক আছি।
হি হি হি! আমি ভাল আছি! আমি ভাল আছি! দাঁড়িয়ে উঠে ঘরের মধ্যেই একটা ঘুরপাক খেয়ে নিয়ে হেসে উঠেই উন্মাদিনী হঠাৎ চীৎকার করে ওঠে, এটা আবার কেন এল? এই রাক্ষুসীটা? তাড়িয়ে দাও তাড়িয়ে দাও ওটাকে। ঘাড় মটকে রক্ত খেতে আসছে।
অতনু একবার দীর্ঘছায়ার মালিক দুটোর মধ্যে একটার মুখের দিকে তাকায়। অনেকটা দূর থেকে ছুটে এসেছে যে অমিতার জন্যে হৃদয়ভরা ভালোবাসা নিয়ে।
কালো আর কঠিন হয়ে উঠেছে সে মুখ অবিশ্বাস্য অপমানে। অবিশ্বাসও যে ষোলআনা! দরজার বাইরে থেকে দেখে নি সে সেই কোলে আছড়ে পড়ার দৃশ্য? মনে মনে কি বলে নি ওঃ পাগল সেজে বৃন্দাবনলীলা চলছে?
ওই অবিশ্বাস আর অপমানে কঠিন কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অতনু বলে ওঠে, তোমার মতন মিথ্যে পাগলদের উচিত শাস্তি হচ্ছে কি জানো?
না, শাস্তির পদ্ধতিটা আর বলা হয় না, মিথ্যে পাগল পাগলীটা জানি দেখাচ্ছি বলে নিজেকে ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সকলের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে বিদ্যুতের বেগে ছুটে উঠে যায় ছাতে।
অমিতা! অমিতা!
পিছনে দ্রুত ধাওয়া করছে মানুষ। তার থেকে এগিয়ে চলেছে মানুষের কণ্ঠের অমানুষিক আর্তনাদ।
অমিতা! অমিতা!
পায়ে পড়ি তোমার, অমন করে ঝুঁকো না।
কিন্তু কে কান দেবে সেই আর্তনাদে? কে ফিরবে সেই ডাকে?
মিথ্যে-পাগলের অপবাদে দিশেহারা হয়ে যে সত্যি উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে, তার কি আর ফিরবার উপায় আছে? পাগল হয়ে গিয়েই যে প্রমাণ করতে হবে তাকে, সে পাগল হয়েছিল।
.
অসতর্কে ছাত থেকে পড়ে গেলে হয়তো বা বেঁচেও যায় মানুষ। ভেঙে-চুরে হাড় গুড়ো হয়েও বেঁচে থাকে।
কিন্তু উন্মত্ত আবেগের টান টান স্নায়ু শিরা নিয়ে ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়লে সে স্নায়ু শিরা কি অটুট থাকে?
না, থাকে না। ছিঁড়ে যায়।
তবু চেষ্টা করতে হবে বইকি। ত্রুটি হয় না সে চেষ্টার। সমস্ত বুদ্ধি আর বিবেচনার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায় যাতে, সেই রকম চেষ্টার।
মেয়ের বিয়েতে যত খরচ হয়েছিল জগন্ময়ের, তার বেশি খরচ হয়ে যায় ঘণ্টাকয়েকের ত্রুটিহীন চেষ্টায়।
ডাক্তার আসে, অ্যাম্বুলেন্স আসে, আত্মীয় আর বন্ধুজনে ছেয়ে যায় বাড়ি। তারপর হাসপাতালে গিয়ে পড়ে সমগ্র সংসার।
পাড়ার লোকে হায় হায় করে বলতে থাকে, ওমা ওদের ছাতে যে এখনো বিয়ের ম্যারাপের বাঁশ বাঁধা!
না, নিজ নিজ কর্তব্যের ত্রুটি কেউ করে না।
পুলিশের কর্তব্য পুলিশ করে। জেরায় জেরায় উৎখাত করে ঘরবার সবাইকে, বাড়িতে কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কি না। কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না। এই একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে একতা আছে কি না। অল্পবয়সী বিধবা মেয়ে, ভিতরে অন্য কোনও ব্যাপার ছিল কি না।
বাড়ির ডাক্তার আর সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তাঁরাই রক্ষা করলেন। তারাই গেরস্থকে উদ্ধার করলেন এই জেরার হাত থেকে।
সার্টিফিকেট দিলেন মস্তিষ্ক বিকৃতির।
একজন মরেছে বলে তো আর সংসারসুদ্ধ সকলের মরলে চলবে না! বাঁচতে হবে।
পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হবে। লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে হবে।
.
অনেকগুলো ঘণ্টা পরে সহসা চোখ মেলে অমিতা। ব্যান্ডেজে ঢাকা আধখানা চোখ।
বাবা!
মা, ওমা, এই যে আমি। হাহাকার করে ওঠেন জগন্ময়।
কেন আমি অফিস চলে গেলাম মা! কেন তোকে কোলে করে বসে থাকলাম না!
আঃ কী করছেন– নার্স ঠেলে নিয়ে যায়, এইজন্যে খারাপ কেসে আমরা পেসেন্টের আত্মীয়দের অ্যালাউ করি না।
মাকে দেখতে চান?
না। শুধু ক্ষমা!
জড়িয়ে জড়িয়ে বলে মৃত্যুপথযাত্রিণী।
একটু পরে আবার নিঃশ্বাসের মত আস্তে উচ্চারণ করে, অতনু!
আর লজ্জা করবার সময় নেই!
এরপর নিজেকে চাবুক মেরে মেরে দেখবে অতনু, গায়ে তার মানুষের চামড়া আছে কিনা।
কিন্তু আর কি হবে দেখে?
অতনু!
বল! বল কি বলবে? বিছানার কাছে মুখ নামিয়ে আনে অতনু। নামিয়ে আনে সেই নিঃশ্বাসের মত মৃদু স্বরে শক্তির সীমানার মধ্যে।
বড় ক্লান্তিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলে অমিতা। তারপর জড়ানো জড়ানো ক্লান্তস্বরে বলে, তোমার কথাই ঠিক। আমার কিছু হয়নি। আমি মিছিমিছি–
কেন এমন করেছিলে অমিতা? কেন এমন করেছিলে? আমায় এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দিলে কেন?
.
নেভার আগে প্রদীপের মত মৃত্যুনীল মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, জব্দ করলাম তোমায়।
অমিতা! অমিতা!
কিন্তু অমিতা বুঝি ততক্ষণে বাইরের জগতের সঙ্গে লেনদেন চুকিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে সাড়া দেবার শক্তি।