অতনু ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, বলে ফেলতে যাচ্ছে, কাকীমা, পাগলটাকে আমার হাতে তুলে দিতে পারেন না? দেখি ওর পাগলামি সারিয়ে দিতে পারি কিনা। মনে করুন না এইটাই বিধাতার নির্দেশ ছিল। তাই
এই যে অতনুদা, আপনার ব্যাগ।
জোরে জোরে এসেছে দীপক। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে।
অতনু তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।
তারপর খুলে দেখে পরীক্ষা করে। কোন্ কোন্ ওষুধ মজুত আছে। মরফিয়া ইনজেকশন দেবে, উত্তেজিত স্নায়ুকে বশে আনতে?
না না, ছুঁচ ফোঁটাতে পারবে না অতনু ওর ওই শীর্ণ হয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে হাতে।
তোমার সেদিনের সেই ঘুমের ওষুধটা আর নেই?
আছে, সেটাই দেব। খাবার জল চাই একটু।
বৌমা! ডাকলেন জয়াবতী।
দুর্ভাগ্যক্রমে চট করে সাড়া পাওয়া গেল না। জয়াবতী তীব্র বিরক্তির সঙ্গে উঠে পড়লেন।
হুঁ! আমি আবার ফরমাস করব! সে সুখ ফুরিয়েছে। এখন এই রকমই হবে, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। ভারী দেহ নিয়ে দুমদুম করতে করতে নীচে নামেন জয়াবতী।
সঙ্গে সঙ্গে দীপকও ব্যস্ত হয়ে নামে, আহা তুমি কেন? আমিই না হয় এনে দিচ্ছি। সিঁড়ি উঠলে তোমার
আমার কিছু হবে না বাবা, এ হচ্ছে মাষকড়াই, এতে পোকা ধরে না।
জয়াবতী খাবার জলের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দীপক এসে পৌঁছে জল ঢালছে।
আমি নিয়ে যাচ্ছি জল। তুমি একটু জিরিয়ে তবে
কিন্তু দীপকই কি বৌ হঠাৎ কোন্ দিকে গেল, সেটা না দেখে যাবে? বৌকে আবার মা ডাকবেন কিনা কে বলতে পারে? তখন?
আশ্চর্য, মাকে তো কখনো ভীতিকর মনে হত না! বৌ আসার পর থেকেই মাকে এত ভয় করছে কেন দীপকের?
.
ভয়! ভয়!
ভয় বস্তুটা বোধকরি প্রেমের সহোদর অনুজ। তাই প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তার গতিবিধি।
তাই এত ভয় অতনুর।
কিন্তু অমিতারও তো ছিল কত ভয়। সব ভয় ঘুচিয়ে এ কী নির্ভীক হয়ে উঠল সে!
হঠাৎ নির্জন হয়ে গেছে ঘরটা। হঠাৎ শুধু অতনু আর অমিতা।
অতনু দ্রুত ব্যগ্র-স্বরে ডাকে, অমিতা!
অমিতা শুধু চোখটা খুলে তাকায়। লাল লাল ফুলো ফুলো চোখ।
অমিতা ওঠো, উঠে বোসো। আমার একটা কথা শুনতে হবে তোমায়।
কিন্তু উন্মাদিনী কেন সহজ সুরে সাড়া দেবে? তাই সে বলে ওঠে, শুনবো না শুনবো না, কারুর কথা শুনবো না আমি।
শুনতেই হবে।
দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে অতনু, যাবার আগে সেই কথাটা শোনা চাই আমার।
না না, তুমি যাবে না। মাটি থেকে মাথা তোলে পাগলী।
যাব না? না গেলে চলবে?
চলবে। তুমি শুধু এখানে বসে থাকবে।
অতনু হঠাৎ ওর দুই বাহুমূল চেপে ধরে ওকে গায়ের জোরে উঠিয়ে বসিয়ে আরও দৃঢ়স্বরে বলে, শুনবে তুমি স্থির হয়ে?
কেন স্থির হবো? আমি যে পাগল হয়ে গেছি? দেখতে পাচ্ছ না আমার দশা? সহসা একেবারে কাণ্ডজ্ঞানশূন্যের মতই কাজ করে বসে অমিতা।
অতনুর কোলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, বলছি চলে গেলে মরে যাব। তবু
.
অতনু কী করবে?
অতনু ওই কান্নায় ভেঙে পড়া পাখীর মত শরীরটুকু নিবিড় করে চেপে ধরবে? ওর সমস্ত শূন্যতা ভরিয়ে দেবে হৃদয়ের উষ্ণতায়?
না কি ঝড়ে এসে পড়া মরা পাখীর মত টেনে ফেলে দেবে ওটাকে কোল থেকে? স্পর্শ থেকে?
না, ঠেলে ফেলে দেয় না। শুধু ঠেলে তুলে দেয় অতনু সেই ডানাভাঙা পাখীটাকে।
তুলে দিয়ে ওর দুটো কাঁধ চেপে ধরে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওর চোখের দিকে চেয়ে চাপা কঠিন স্বরে বলে, মিছিমিছি এরকম করছ কেন? তোমার তো কিছু হয় নি।
রোগিণী কেঁদে ওঠে না, কেঁপে ওঠে। কেঁপে উঠে বলে, আবার আমায় বকছে! আমার এত কষ্ট!
থামো!
অতনু বুঝি নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে চায়? তাই ওর কাঁধ দুটোয় ঝাঁকুনি দিয়ে তীব্রস্বরে বলে, থামো! এ রকম করতে লজ্জা হচ্ছে না? কিছু তো হয় নি তোমার!
ওমা, এত কষ্ট, তবু বলছে কিছু হয় নি! চীৎকার করে নয়, গেঙিয়ে গেঙিয়ে বলে অমিতা।
অতনুর কি নেশা লেগেছে? কতটা কঠোর হওয়া যায় তার পরীক্ষা করছে? সেইটাই ওর চিকিৎসাপদ্ধতি?
নইলে কেন অমন রূঢ় হয়ে ওঠে, রুক্ষ হয়ে ওঠে।
সবাইকে ঠকাতে পারো, আমায় ঠকাতে পারবে না। আমি জানি তোমার কোনও অসুখ করে নি! সব তুমি ইচ্ছে করে করছ।
পাগলী একবার চোখ তুলে তাকায়। যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে, ইচ্ছে করে করছি?
করছই তো? শুধু শুধু মিথ্যে পাগলামি করে গালে মুখে চুনকালি মাখছ। তোমার লজ্জা করছে না, আমার যে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
আমার জন্যে তোমার মাথা কাটা যায়?
যায় না?
সহসা স্থির হয়ে যায় অমিতা। শান্ত হয়ে যায়। বুঝি একেবারে সহজ হয়ে যায়।
আচ্ছা আর করব না।
ঠিক বলছ?
ঠিক বলছি, ঠিক বলছি।
শান্ত হয়ে যাওয়া মানুষটা আবার হঠাৎ উদ্বেল হয়ে ওঠে। বুঝি নেশার ঘোর কেটেও কাটে নি। লেগে আছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। তাই বলে, শুধু তুমি একবার আদর কর।
ভয়ঙ্কর একটা উদগ্র বাসনাকে স্নায়ুর মধ্যে নিষ্পেষিত করে ফেলতে ভয়ঙ্কর একটা পরিশ্রম হয় না? সেই পরিশ্রমে আলোড়িত হয়ে ওঠে না রক্তমাংসের একটা মানুষ?
হয় বইকি! কিন্তু সে আলোড়ন কি ধরা পড়তে দেওয়া হবে? প্রশ্রয় দেওয়া হবে নিন্দনীয় একটা অসামাজিক ইচ্ছেকে?
না, প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাই বলতে হয়, তাতে লাভ?
লাভ, লাভ? ভয়ঙ্কর লাভ! করো না গো একটু আদর। এতদিন পরে এসে শুধু বকছ আর বকছ। আবার কোলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে।