তবে আর অতনু দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? চলে যাওয়াই তো উচিত।
বড় জোর বলা যায় দীপুর বৌ চলে গেছে নাকি?
যা বলা যায়, তাই বলে।
জয়াবতী বলেন, না, আজ আর কি যাবে? অষ্টমঙ্গলা হোক। আর এখনকার বৌরা বাপের বাড়ি যায় না কি? লজ্জার যুগ তো নয়!
লজ্জার যুগ নয়।
তবু নির্লজ্জের মত অবান্তরের ভূমিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
অতএব অতনুকে বলতে হয়, যাচ্ছি তাহলে। কাকাবাবু অফিস যাবার সময় বলে এসেছিলেন একবার খোঁজ নিতে–
কাকাবাবু!
উনি? উনি বলেছিলেন খোঁজ নিতে? উনি গিয়েছিলেন তোমার কাছে?
হ্যাঁ ওই অফিস যাবার সময়
সহসা অনেকক্ষণের নিস্তব্ধ হয়ে থাকা বাড়িটা ঝনঝনিয়ে ওঠে, আমার মা কোথা গেল? আমার মা?
ওই দেখ।
জয়াবতী গর্বে, পুলকে, ব্যাকুলতায়, ব্যস্ততায় ধুপ ধুপ করতে করতে ছোটেন।
কিন্তু অতনু?
সে কি ওঁর পিছন পিছন ছুটবে? নাকি পড়শীর অধিকারহীন নিরুপায়তায় তাকিয়ে থাকবে? না দাঁড়িয়ে থাকবে ওই স্বরটুকু আবার কি বলে শোনবার জন্যে?
হঠাৎ নন্দা এসে দাঁড়ায়।
বিনা ভূমিকায় বলে, তুমি তো ইচ্ছে করলেই একটু সাহস দেখাতে পারো অতনু?
কি বলছেন? চমকে প্রশ্ন করে অতনু।
বলছি তুমি তো ইচ্ছা করলেই অমিতাকে বিয়ে করতে পারো।
এটা কি!
ব্যঙ্গ! অকারণ নিষ্ঠুরতা!
অতনুর মন বোঝার ছল? কথার জাল ফেলে তুলে আনবার চেষ্টা অতলে তলিয়ে থাকা সেই মনকে?
একটু বুঝি কঠিন হয়ে যায় অতনু। স্থির স্বরে বলে, ইচ্ছে করলেই পারা যায় এই আপনার বিশ্বাস?
নিশ্চয়। ইচ্ছের জোর থাকলে কী না হতে পারে? আমি তো কাল থেকে কেবল ভাবছি, তুমি এটা বলছ না কেন?
বললেই সে বলাকে মূল্য দেওয়া হবে!
না হয় অধিকারের জোর খাটাবে।
অধিকার! অধিকার কোথায়?
সহসা হেসে ওঠে না। বলে, সেটাও বলে বোঝাতে হবে? না, তোমাকে বোঝাতে আসাই দেখছি বিড়ম্বনা হয়েছে। বলে চলে যায় না।
এই ধরন নন্দার। কথাটা ছুঁড়ে মেরেই চলে যায়। তাকিয়ে দেখে না তার প্রতিক্রিয়াটা কি হল। হয়তো প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিঃসংশয় বলেই দেখে না।
অতনু কি নন্দার নির্দেশে কান দেবে? বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে
ঝন ঝন ঝন!
কণ্ঠস্বর নয়, কাঁচের বাসন ভাঙার শব্দ।
পাগলিনী চেঁচাচ্ছে, সেই শব্দের সঙ্গে বলছে, তুমি চলে যাও। তুমি থাকবে না। তুমি মহাদির মা। তুমি ওকে তাড়িয়ে দিলে, ওকে মারলে।
অতনুদা! অতনুদা!
দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে ডাকে দীপক, আপনি আছেন? উঃ বাঁচলাম! শীগগির ওপরে আসুন। ভয়ানক কি রকম করছে।
তাহলে এখন যাওয়া চলে।
বাড়ির বড় ছেলে বিপদে পড়ে ডাকছে। বাড়ির কর্তা ভার দিয়ে গেছেন।
.
খালি পায়ে নয়, খালি পায়ে নয়, চটি পরে! রমলা সাবধান করে দেয়, ওঘরে কাঁচের গ্লাস ভেঙে ছড়াছড়ি।
যাচ্ছি না এক্ষুনি ওঘরে, আবার কি হল? বহু কণ্ঠের বহু উচ্চারিত প্রশ্নটাই আবার উচ্চারণ করে অতনু।
কি জানি। সকাল থেকে তো খুব খারাপ ছিলেন না। নীচে থেকে বোধহয় আপনার গলার সাড়া পেয়ে মাকে কি বলেছেন। মা বললেন, চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস! ওকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছ–বলে রেগে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে
দেখছি আমিই শনি হয়ে এসেছিলাম এবার!
রমলা একবার চোখ তুলে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বলে, যাবেন না ওঘরে?
তাই ভাবছি। তাতে হিত করব না অহিত করব বুঝতে পারছি না।
তা অবিশ্যি সত্যি, রমলাও বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না তার শাশুড়ির মনোভাব। কিন্তু অমিতার ঘর থেকে দীপক আবার ডেকে উঠেছে অতনুদা!
ও ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায় অতনু।
.
চারিদিকে ভাঙা কাঁচের টুকরো, তার মাঝখানে মেঝেয় লুটোচ্ছে অমিতা! ওকে তোমরা খালি খালি তাড়িয়ে দাও, ওকে মার। তাই তো ও চলে যাবে। অনেক দূরে চলে যাবে।
জয়াবতী শুধু ওর বিপর্যস্ত মাথাটা সামলাচ্ছেন।
মত্ততায় অস্বাভাবিকতা আসে। কিন্তু অস্বাভাবিকতারও মাদকতা আছে বইকি! তার নেশাও বাড়াতে বাড়াতে বাড়ে। নইলে কি করে পারে সুস্থ সহজ লোকে দু বাহু তুলে নগর সংকীর্তন করতে?
স্নায়ু শিরা সব টান টান হয়ে উঠেছে। ওকে আর সহজে রাশে আনা যাবে না। ও স্নায়ুকে নিস্তেজ করে দিতে হবে, শিথিল করে দিতে হবে।
দীপু, আমার বাড়ি থেকে ওষুধের ব্যাগটা আনিয়ে দিতে পারবি? একটু চট করে।
আমিই যাচ্ছি।
তুই আর কেন এই রোদ্দুরে? চাকর টাকর কাউকে বৌদিকে বললেই
থাক না, আমিই যাচ্ছি।
বাবা অতনু! জয়াবতী আর বিরস নেই। আবার কাতর হয়ে উঠেছেন।
অতনু ইসারায় কথা বলতে বারণ করে। ঘরে ঢুকে নীচু হয়ে আস্তে আস্তে কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে চেষ্টা করে।
সহজ কথা বলা খুব শক্ত। কিন্তু শক্ত কাজ করতে পারাই তো পৌরুষের মহিমা।
ইস! এমন সুন্দর কাটগ্লাসের গ্লাসটা ভাঙল! আচ্ছা এক আহ্লাদী মেয়ে হয়েছে বটে আপনার?
জয়াবতী কথার এ টোনে মর্মাহত হন। এই কি হালকা রঙ্গরসের সময়?
হতাশ ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, আর গেলাস! আমার কপালটাই ভেঙে চুরমার করে দিল!
ওর কি সাধ্যি যে আপনার কপালে হাত দেয়? নিজের কপালই ভাঙছে।…অমিতা, মুণ্ডুটা মাটিতে ঘষে ঘষে সত্যিই যে ভাঙবার জোগাড় করছ, কি হচ্ছে ওটা?
জয়াবতী ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছেন, বলে ফেলতে যাচ্ছেন, ওর ভাঙা কপালখানা জোড়বার ভার তুমি নিতে পারো না অতনু? মিলিটারীর ডাক্তার বলে শুধু ভাঙা হাত পাই জুড়বে? জুড়তে পারবে না ভাঙা অদৃষ্ট?