হবে বলেই সঙ্গে সঙ্গে তাই হইয়ে ফেলবে? মেয়েরা তোদের মত নয়।
তুমি তো সব সময় ছেলেদের নিকৃষ্ট ভাবো। ও নিজে কি বলছিল, জানো?
বলেই হঠাৎ লজ্জা পেয়ে চুপ করে যায় দীপক।
ও আবার কী বলল? এবার আলপিন খোঁজার জন্যে খাটের তলায় মাথা ঝোকাচ্ছে অমিতা।
কথাটা বলল নেহাত অন্যমনস্কের মত। আর বলল নেহাত দীপক বলেই। দীপকের সঙ্গে ছাড়া এত কথা আর কার সঙ্গে কয় অমিতা?
না, বলব না। বলে আপন মনে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে দীপক। ভাগ্যিস ছোড়দিটা মাথা ঝুঁকিয়েছে, নইলে হাসিটা দেখে ফেলত।
বলব না বলাতেও যেন অমিতার কোন কৌতূহল নেই। আলপিন তুলে বলল, পরিবেশন সুরু হয়ে গেছে রে?
দীপক মনে মনে বলল, ইস! এখন ওই কথা!
সাধে কি আর ভাবছিল, ছোড়দির মনটা একদম মরে গেছে। ছোড়দি একবার অতনুর সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা, এইটাই তো ওর এখনকার প্রধান প্রশ্নের বিষয় ছিল। কিন্তু অতনুর খবরে তো গ্রাহ্যই করল না ছোড়দি।
গ্রাহ্য করলে অন্তত এক্ষুনি খোঁজ নিতে বসত না পাতা পড়েছে কিনা!
রেগে বলল, কেন, তুই তা হলে এবার কোমর বেঁধে লেগে যাবি?
অমিতা হাসল, কোমর বাঁধলে তোদের লোকসানটা কোথায়?
লাভলোকসান নিয়েই সর্বদা চলবে নাকি মানুষ? আরও রাগ করে বলল দীপক।
অমিতা আবার হাসল, প্রেমে পড়লি, বিয়ে করলি, তবু ছেলেমানুষই থেকে গেলি!
লাভলোকসান দেখবে না তো কি নিয়ে তবে চলবে রে মানুষ?
মানুষ মানুষের মতই চলবে। সুখ দুঃখু, সাধ বাসনা, ইচ্ছে অনিচ্ছে, ভাল লাগা মন্দ লাগা নিয়ে।
ওগুলো অমানুষের।
যা যা, আমরা সব তাহলে অমানুষ!
তুই বড় তাড়াতাড়ি রেগে যাস! বৌটার যে কি দশা হবে?
বাঃ সে কথা তো আমাদের হয়েই গেছে। জানো না?
তোদের কখন কি কথা হয়ে যাচ্ছে আমি জানছি?
শুনতে চাইলে তো জানবে? ঠিক হয়ে গেছে, আমরা কেউ কারুর ওপর রাগ করব না। করব না এই কথাটা একটা স্ট্যাম্প পেপারে লিখে, দুজনে সই করে রেখে দেবো। যেই। একজন রাগ করবে, তার নামের সামনে ধরে দেখানো হবে কাগজটা।
অমিতা মৃদু হেসে বলে, আর যখন তা সত্ত্বেও তার রাগ ভাঙবে না, তখন চুক্তিভঙ্গের অপরাধে তার নামে আদালতে নালিশ করতে ছোটা হবে, কেমন? যত সব ছেলেমানুষী! কই বললি না ছাতের কী অবস্থা?
আরে বাবা, এই মাত্তর দেখে এসেছি ফার্স্ট ব্যাচের পাত রেডি, আগে মহিলাদের আর শিশুদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিশু আর মহিলা তো একই শ্রেণীর! বলে হেসে চলে যায় দীপক। আর–আর একবার ভাবে, ছোড়দির মনটা একেবারে মরে গিয়েছে।
তারপর তো মেয়েরা অনেকে খেতে বসেছে, কে কোথায় হই হই করে বেড়াচ্ছে, অমিতা যে ঠিক কোন্ কর্মকেন্দ্রে আছে তা কেউ দেখে নি।
দেখল এসে মহাশ্বেতা। যে মহাশ্বেতা সর্বঘটের কাঠালীকলারূপে সারা বাড়ী ঘটঘটিয়ে বেড়াচ্ছিল।
মেয়েরা খেতে চলে যাওয়াতে দোতলাটা প্রায় নির্জন, আর কনে সাজাবার জন্যে নির্বাচিত এই কোণের দিকের ঘরটার তো ত্রিসীমানায় কেউ নেই, মহাশ্বেতার যে এখানে কী দরকার পড়েছিল মহাশ্বেতাই জানে।
সে ভেজানো দরজাটা হাত দিয়ে একটু ঠেলেই ভিতরের দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে গেল।
তখনো অমিতা তাকে দেখতে পায় নি।
অমিতা তখন ঘরের প্রকাণ্ড ড্রেসিং আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে…হ্যাঁ, অসম্ভব অবিশ্বাস্য হলেও নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারে না মহাশ্বেতা? নিজের চোখে দেখল, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে কপালে টিপ পরছে অমিতা! কুঙ্কুম আর চন্দনে সাজিয়ে তোলা ত্রিনেত্রর গড়নের লম্বাটে একটি টিপ। নিখুঁত করে আঁকছে।
আয়নায় অমিতার ছায়া পড়েছে। পুরো শরীরের ছায়া। যে শরীরটায় জড়ানো রয়েছে নতুন বৌয়ের একখানা জমকালো লাল বেনারসী শাড়ি।
নতুন বৌয়ের শাড়ি আর নতুন বৌয়ের কতকগুলো গয়না দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে অমিতা। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্যের মত।
তা সে জ্ঞান মহাশ্বেতাও হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি! বেশ কিছুক্ষণ পাথর হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল সে।
জ্ঞান ফিরল তখন, যখন দেখল শাড়ির আঁচলটা মাথা দিয়ে ঘুরিয়ে টেনে মুঠোয় চেপে ধরে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখছে অমিতা, আর তার ঠোঁটে মৃদু একটু হাসির রেখা!
অমি!
ঘরে ঢুকেই ভিতরের ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়েই মহাশ্বেতা চাপা আর্তনাদ করে উঠল, অমি!
অমিতার কি এতক্ষণে বাহ্যজ্ঞান ফিরল? না সেটা চিরদিনের মতই হারিয়ে ফেলেছে সে? চোখে তার দৃষ্টিটা ঠিক কি? চমকে উঠেছিল কি একবার?
নাঃ, ওঠেনি বোধ হয়। চমকে ওঠাটাই উচিত ছিল, এই অস্বাভাবিক কাণ্ডের মধ্যেও কিছুটা স্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যেত তবে, কিন্তু তা সে উঠল না।
তার বদলে?
তার বদলে সহসা মহাশ্বেতাকে জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, কেমন দেখাচ্ছে বলে তো মহাদি?
মহাশ্বেতা কিন্তু এই অকস্মাৎ বজ্রাঘাতে স্তম্ভিত হয়ে মাথাটা ঠিক হারাল না, দুহাতে অমিতার দুই কাঁধ ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল, অমি! অমি! এ কী সর্বনাশ হল রে তোর অমি!
অমিতার হাসির পালা, কেন গো মহাদি, সর্বনাশ কি? কেমন কনে সেজেছি, কেমন টিপ এঁকেছি
ওলো সর্বনাশী, কার জন্যে-কার জন্যে? তাকে ধরে অনবরত ঝাঁকুনি দিতে থাকে মহাশ্বেতা।
আঃ, লাগে না?
ছাড়িয়ে নেয় অমিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিক ফিক করে হেসে বলে, কেন, বরের জন্যে।