কিন্তু শুনতে একজন পায়, সে নতুন বৌ রমলা। কি জন্যে সে এদিকে এসেছিল কে জানে।
মিনিট খানেক সে বোধ করি পাথরের পুতুলের মতই দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আস্তে কাছে এসে বলে, তিলককে পড়াতে আমিও তো পারি মা!
হঠাৎ জয়াবতীর যেন ব্রহ্মারন্ধ্রে জ্বালা ধরে যায়। ওঃ, সহৃদয় প্রস্তাব জানাতে এসেছেন। তার মানে আগাগোড়া কথা শুনেছেন। বৌয়ের উপর জয়াবতী আদৌ প্রসন্ন হতে পারেন নি। একে তো তার এক-ফোঁট্টা ছেলের হঠাৎ প্রেমের নায়ক হয়ে ওঠার আগাগোড়া দোষ সেই তার নায়িকাটির উপরই চাপিয়ে রেখেছিলেন, তার উপর বৌ আসতে না আসতেই এই দুর্বিপাক। বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকেই কেউ কিছু করে দিল কিনা, এ সন্দেহের ধোঁয়াও মাঝে মাঝে মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে।
ছেলের বৌকেও জয়াবতীর জায়েদের মতই একজন মনে হল, আর আপাতত তার কোন দোষ খুঁজে না পেয়ে ভিতরের ঝাঁজ প্রকাশ করলেন একটা অবান্তর কথায়। বলে উঠলেন, দ্যাওরদের নাম ধরে ডাকার রীতি এ বাড়িতে নেই বৌমা, ওকে তুমি ছোট ঠাকুরপো বলবে।
রমলা অন্যদিকে যতই চালাক হোক, সংসারে এখনও অনভিজ্ঞ, তাই হেসে বলে, নাইলে যাকে মাথা মুছিয়ে দিতে হয়, তাকে আবার ঠাকুরপো!
কিন্তু জয়াবতী এ পরিহাসে হাসেন না। ব্যাজার মুখে বলেন, আমি যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম, আমার ছোট দ্যাওরকে ধরে ভাত খাইয়ে দিতে হত। তবুও তাকে ছোট ঠাকুরপো ডাকি বৌমা!
এবার আর বুঝতে অসুবিধে হয় না। রমলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
জয়াবতী বলেন, দীপু কলেজ যাবে না?
কলেজ!
দীপক কলেজ যাবে, এমন অসম্ভব কোনও কথা রমলার মনের জগতে ছিল না। শুধু ভেবেছিল, আজ বাড়ির কর্তারা যে যার কর্মস্থানে রওনা দিয়েছেন, আর ছোড়দিও বেশি কাঁদছে না। অতএব হয়তো আজ দুপুরটা
এখন জয়াবতী সেই নিঃশঙ্ক চিত্তে ঢিল ছুঁড়লেন। বললেন দীপু কলেজে যাবে না?
যে জয়াবতী জগন্ময়কে জুলুম করছিলেন, বাড়িতে থাকবার জন্যে।
রমলা মাথা নেড়ে বলে, জানি না।
জান না? সকাল থেকে তো ওপরেই রয়েছ বাছা! যাবার কোন উযুগ দেখলে না?
না তো।
তা জানি! আর কি পড়া লেখা হবে? জয়াবতী ভবিষ্যৎবাণী ঘোষণা করেন, এইবার সবই জলাঞ্জলি।
রমলা বোধকরি পতিনিন্দাটা বরদাস্ত করতে পারে না, তাই বলে ফেলে, ছোড়দির এইরকম–
ছোড়দি তো এখন পাগল হয়ে নাচতেই থাকবে, তার ছুতোয় কারুর কিছু বন্ধ রাখবার দরকার নেই।
যে জয়াবতীর কথায় মধু ঝরে, তার রসনায় এমন তিক্তরস? রমলা অবাক হয়ে যায়।
বিষণ্ণভাবে বলে, আচ্ছা বলছি গিয়ে।
বলবার কিছু নেই। যে যা ইচ্ছে করুক। শেষে তো দোষ হবে মার!
উল্টোপাল্টা কথায় হাঁপিয়ে উঠে রমলা সরে যায়।
আর ঠিক এই সময় জয়াবতীর এই তিক্ত মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ায় অতনু।
আর আর অতনুকে দেখে হাতে চাঁদ পান না জয়াবতী। পান না পরম আশ্বাসের অভয়। বরং মনটা বিমুখ হয়ে ওঠে তার।
আবার ওর আসার কী দরকার ছিল?
মেয়েটা যদি বা ঝোঁক বদলেছে।
আজ তো অমিতা শুধু মা। সেই সম্পদটুকু মুহূর্তে লুঠ করে নিতে পারে এই অতিভদ্র নিরীহ চেহারা দস্যুটা।
জয়াবতী ভাবেন, আজ ওর এ আক্কেল হওয়া উচিত ছিল, আর আসার কার নেই। দরকার থাকলে আমরাই ডেকে পাঠাতাম।
কিন্তু অতনু তার ছেলের বৌ নয় যে বিরক্তিটা প্রকাশ করে বসবেন। তাই শুকনো গলায় বলেন, এসো বাবা! আজই যাওয়ার ঠিক করলে তা হলে?
হ্যাঁ। আজ অবস্থা কেমন? রিপোর্ট কি বলছে?
জয়াবতী গতকালকের সমস্ত লজ্জার কলঙ্ক মুছে ফেলবার সুযোগ পেয়ে আত্মস্থ ভঙ্গিতে বলেন, আজ একেবারে অন্য রকম। আজ সকাল থেকে শুধু মা আর মা। আমার মা মরে গেছে বলে কেঁদেই নিল এক পালা। তারপর মা কোথা গেল, মা চা খেয়েছে কিনা, এই করে বেড়াচ্ছে।
গুড। অতনু বলে, খুব ভাল কথা। খেয়েছে কিছু? ডাক্তার অতনু ডাক্তারের মতন কথা বলবে বইকি।
জয়াবতী যদি বলতে পেতেন হ্যাঁ খেয়েছে, তাহলে বেঁচে যেতেন। কিন্তু একেবারে পুকুর চুরিটা করা শক্ত। তাই বলেন, ওই তো ওইটাই এখনো স্বাভাবিক হয় নি।
যেন আর সবটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
খাওয়ান! আপনিই একটু চেষ্টা করে খাওয়ান। আপনাকেই যখন ইয়ে করছে।
দেখি। বলে নীরস মুখে দাঁড়িয়েই থাকেন জয়াবতী। বলেন না, যাও না দেখে এসো।
কাল বলেছিলেন। কাল মনের মধ্যে নানা চিন্তার ওঠাপড়া ছিল। আজ হঠাৎ বিরূপতা আসছে। গতরাত্রে জগন্ময়ের সঙ্গে কথাবার্তায়, মনের অতি নিভৃতে যে ইচ্ছেটি অঙ্কুরিত হয়ে উঠছিল, সেটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। তাই আজ অন্য ভাব।
আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে জয়াবতীর, বেশ তো, তুমি যদি পাড়াপড়শীর মতই ব্যবহার কর, আমিও তাই করব! বাইরের উঠোন থেকে বিদায় দেবো। কেন, তুমি নিজে থেকে একবার প্রস্তাব করতে পারতে না? বলতে পারতে না, কাকীমা, ওকে আমার হাতে দিন। আমি ওকে সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করব। ওকে-সুখী করব। তা নয়, রুগীর খবর নিয়ে মহানুভবতা দেখাতে এলেন! ঠিক আছে, খবরই নিয়ে যাও।
.
অতনু ভাবছে ওঁর মুখে আজ এমন অপ্রসন্নতা কেন? গতকালকের প্রতিক্রিয়া? এই বিরূপ মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলা সম্ভব, কাকীমা, ওকে তো আপনারা রাখতে পারলেন না! ভেঙে ফেললেন ছড়িয়ে ফেললেন, সেই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিন না। আমি চেষ্টা করে দেখি
কেউ কারুর মনের মধ্যেটা দেখতে পায় না, এই হচ্ছে পরমতম লাভ। কেউ কারুর মনের কথা বুঝতে পারে না, এই হচ্ছে চরমতম লোকন।