আমার মা কই গো? আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
শোনো কথা। এই তো তোর মা। সেজখুড়ি চিনিয়ে দেয়।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওই তো আমার মা!
অমিতা ধুলোর ওপর বসে পড়ে ভাড়ার ঘরের মেজেয়। সামনে পড়ে থাকা তরকারির ঝুড়ি থেকে একটা বেগুন তুলে নিয়ে সেটা লোফালুফি করতে করতে বলে, আমার মা চা খেয়েছে?
জয়াবতী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, খেয়েছি মা। বুকের আগুনের জ্বালায় তো পেটের আগুনের জ্বালা চাপা পড়ে না। বুঝি-বা দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে।
সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তবু বলব দিদি, তোমার ভাগ্যকে হিংসে না করে থাকা যায় না। তোমার পাগলছাগল মেয়ে, তাও ধড়ফড়িয়ে নেমে আসে মায়ের খাওয়া হল কিনা খোঁজ করতে। হাতের কাছে খাবার দেখতে পেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় থালা বোঝাই করে। আর আমার মাথাবুদ্ধিওলা মেয়ে, মা খেলো কি না খেলো, মরল কি বাঁচল, খোঁজও করে না।
জয়াবতী আহত স্বরে বলেন, আমার মেয়ে চিরদিন পাগল ছাগল ছিল না সেজবৌ! দুদিন আগেও সমগ্ৰ সংসার মাথায় করে বেড়িয়েছে।
আহা, সে আর কে অস্বীকার করেছে? এখনকার কথাই বলছি।
অমিতার দিকে আড়নজরে তাকিয়ে দেখেন ওঁরা, আজ কি একটু ভাল? একটু একটু করে কি ভাল হয়ে যাচ্ছে? এই ভাবেই সহজ হয়ে যাবে?
সেজখুড়ি স্নেহঢালা গলায় বলেন, কিছু খাবি রে অমিতা? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?
অমিতা আস্তে মাথা নাড়ে।
আহা না খেয়েই তো কাটছে। কত খিদে পেয়েছে বেচারার! কী খাবি বল?
অমিতা গম্ভীর ভাবে একটু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, দেশলাই।
দেশলাই! দেশলাই খেতে চাইছে।
আর জয়াবতী কিনা আশায় বুক বাঁধছেন সেরে উঠছে বলে?
দেশলাই কি খাবার জিনিস অমি? সেজখুড়ি আবার মুক্তা অন্বেষণে রহস্যের সমুদ্রে ডুবুরি নামান, দেশলাই কেউ খায়?
খায় না? ও! তাহলে বালতি খাবো।
জয়াবতী ডুকরে কেঁদে ওঠেন, অমি, আমি যে বড় আশা করছিলাম তুই সেরে উঠছিস।
কান্নার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে না আসে, কি হল? আবার কি হল আপনার দিদি? তার কণ্ঠে বিরক্তি।
মেয়েটা খেতে চাইছে, তাই মা কাঁদছে। অমিতা ঘটনাটা বোঝায় প্রশ্নকারিণীকে।
নন্দা শান্তভাবে বলে, কী খেতে চাইছে মেয়েটা?
অমিতা অম্লান বদনে বলে, বেগুনভাজা!
ও আমার কপাল, তুই কি বেগুনভাজা খেতে চেয়েছিলি? জয়াবতী ছোট জার কাছে হৃদয় জ্বালা ব্যক্ত করেন, জানো ছোট বৌ, বলে কি না দেশলাই খাবো, বালতি খাবো?
বেশ করেছে বলেছে! বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে ওর মুণ্ডু খাওয়া হয়েছে, ও আর এখন ও ছাড়া কি চাইবে? বলে গলাটা খাটো করে বলে, আপনাদের কথাবার্তাগুলো আর একটু বুদ্ধিমানের মত হওয়া উচিত। সব কিছুই খুঁচিয়ে তুললে বাড়ে, এ জ্ঞানটুকু অন্তত থাকলে ভাল হয়।
স্নেহময়ী সেজখুড়ি ততক্ষণে তৎপর হয়ে অমিতার হাতের বেগুনটা নিয়ে চারখানা করে কুটে হাঁক দেন, বামুনদি, এই বেগুন কখানা নিয়ে যাও তো, চট করে ভেজে দাও।
বলাবাহুল্য বামুনদির রান্নাঘরে অমিতার আহার নিষেধ। মহারাজজীর চরণে আত্মনিবেদিত এই সংসারটিতে অনাচার প্রবেশের ছিদ্রপথ নেই। এ যুগের মত বিধবার খাওয়ায় এলোমেলো ঘটে নি এখনো।
কিন্তু এখন যে সেজগিন্নী বামুনদিকে ডাকলেন, সে কি আচার আচরণ ভুলে গেছেন বলে? না কি মনে করলেন আর অমিতার বিচার কি? সমস্ত বিচার বিবেচনাই যখন হারিয়ে ফেলেছে।
জয়াবতী কান্না ভুলে তাড়াতাড়ি বলেন, বামুনদি আবার কোন্ হেঁসেলে
কিন্তু এ দুর্ভাবনার নিরাকরণ স্বয়ং অমিতাই করে দেয়। হঠাৎ ওগো বাবাগো! আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছে, বলেই বেদম ছুট মারে অমিতা।
ভেতরে জ্ঞান আছে–সেজগিন্নী মন্তব্য করেন, বামুনদির হেঁসেলে খেতে নেই। তা বোধ রয়েছে।
তা রয়েছে। নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, পাগলের মধ্যেও ছিটেফোঁটা বোধ থাকে। থাকে না শুধু সহজদের।
সব সময় তুমি অমন হুল ফুটিয়ে কথা কও কেন বল তো ছোট বৌ? সেজগিন্নী তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেন।
নন্দা কিন্তু নির্বিকার। হেসে উঠে বলে, পরীক্ষা করে দেখি, চামড়াটা কত মোটা।
হ্যাঁ, এমনি করেই প্রবাহিত হয়ে চলে একান্নবর্তীত্বের মাহাত্ম্যধারা। জগন্ময়ের সংসার পাড়ার লোকের দৃষ্টান্তস্থল।
.
ছোট ছেলেটার ভিজে মাথাটা ভাল করে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন জয়াবতী। নিজে নাইতে পারে, নিজে মাথা ভাল করে মুছতে পারে না। এ যাবৎ ও ভারটা অমিতারই ছিল, আজ দুদিন পরে জয়াবতীর খেয়াল হয়েছে। টেনে ধরে মাথা মোছাচ্ছেন ঘষে ঘষে।
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, আঃ লাগছে যে!
লাগছে কি আবার! ভিজে মাথায় থাকলে অসুখ করবে না?
ছোড়দি তো লাগিয়ে দেয় না!
আর ছোড়দির কথা বলে কি হবে? ছোড়দি তো আমার মাথায় মুগুর মারলো।
মুগুর মারলো! ছেলেটা চমকে মায়ের মাথার দিকে তাকায়।
কি জানি হবেও বা। পাগলরা তো মানুষকে মারে ধরে! কিন্তু ছোড়দি কেন পাগল হল? সে তো রাস্তার ভিখিরিরা হয়।
জয়াবতী দুঃখের মধ্যেও দুঃখের হাসি হেসে বলেন, হাতে করে কি আর মারল? এই যে অসুখ করল এইটাই আমার পক্ষে মার।
ছেলেটা ম্লানভাবে বলে, ছোড়দি আর ভাল হবে না? পাগলই থেকে যাবে?
ভগবান জানেন। ভরসা তো দেখছি না।
তা হলে আমাদের কে পড়াবে?
আবার অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে, আত্মবিস্মৃত জয়াবতী আক্ষেপ ব্যক্ত করেন, মনে করেছিলাম, যা হল তা হল, তবু সংসারটার একটা সুব্যবস্থা হল। আমারও একটু গতরের আসান হচ্ছে, ওঁরও পয়সার দিকে সহসা বোধ করি চৈতন্য ফেরে জয়াবতীর। চুপ করে যান। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন কেউ শুনতে পেল কিনা।