একবার না হয় দেখা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসব।
যা খুশি করো। চিরদিনই তো দেখলাম, সকল জ্বালা আমার।
এত অল্পের উপর দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে তা আশা করেন নি জগন্ময়। পুলক গোপন করে তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে নেন। অফিস টাইমের ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পথে বেরিয়ে কি মনে হয় কে জানে, গুটি গুটি অতনুদের বাড়ির দিকে এগোন।
অতনুর দাদা অবনী ব্যস্ত হয়ে বলে, কাকাবাবু যে! কেমন আছে অমিতা?
জগন্ময় বোধকরি নিজের অফিস বেরোনোর সমর্থনেই তাড়াতাড়ি বলেন, একটু ভালর দিকে বলেই তো মনে হচ্ছে। সেই ভরসায় বেরোচ্ছি একবার। অনেক কামাই হয়ে গেছে। বিজু, হিরণ, এদের কারুরই তো থাকবার জো নেই, কামাই হয়েছে দুতিন দিন। দীপু থাকবে অবিশ্যি, তা সে তো তেমন ইয়ে নয়। তাই অতনুকে বলে যেতে এসেছিলাম, একবার যেন খোঁজ নেয়। যতই হোক সে ডাক্তার মানুষ, একটা ভরসা। আজ আছে তো?
হ্যাঁ আছে। আজ সারা দিনটা আছে। রাত্রের গাড়িতে যাবে। প্লেনের টিকিট তো পায় নি বলছে।
বাড়ি নেই বুঝি? ইতস্তত প্রশ্ন করেন জগন্ময়। মুখোমুখি বলে যেতে পারলেই যেন ভাল ছিল। অবনী গ্রাহ্য করে বলবে কি না কে জানে।
অবনী বলে ওঠে, বাড়ি আছে। ঘুমোচ্ছ এখন।
ঘুমোচ্ছে এখনও?
তাই তো দেখছি। সারারাত ছাতে পড়েছিল, সকালবেলা ঘরে এসে ঘুমোচ্ছে।
আচ্ছা থাক। উঠলে মনে করে একটু বোলো বাবা। তোমাদের কাকীমাও তাহলে একটু ভরসা পান।
নির্বোধ জগন্ময় নিজের পথ সরল করতে, যে কুমীর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আবার তাকে ডেকে নিয়ে আসেন খাল কেটে।
.
হ্যাঁ, সমস্ত রাত ছাতে পড়ে ছিল অতনু।
আর ভাবছিল, জীবনটাকে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করা যায় না? এ যুগে এত সাহস, এত দুঃসাহস, অতনু পারে না একবার সাহস করে প্রস্তাব করতে? বলতে পারে না, তোমরা তো জিনিসটাকে রাখতে পারলে না, হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেললে! ওই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিতে পারো না? দাও না? আমি একবার চেষ্টা করে দেখি সেই টুকরোগুলো জুড়ে আবার আস্ত পুতুল গড়ে তুলতে পারি কি না। তোমাদের তো তাতে কোন লোকসান নেই, অথচ আমার পরম লাভ।
বলা কি অসম্ভব?
দ্বিধাগ্রস্ত মন সারারাত শুধু চিন্তা করেছে। সর্বসন্তাপহারিণীর দেখা মিলেছে একেবারে ভোরবেলা। যখন ওবাড়িতে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গেছে, আর পাগলিনী এক নতুন সুর নিয়ে, • কান্নার ঢেউ তুলেছে।
.
কিন্তু সাহস করে বলতে পারার অভাবেই তো কত জীবন অর্থহীন হয়ে যায়, কত জীবন বিস্বাদ!
ওকে আমার চাই, তোমাকে আমি নেবো, এ কথা উচ্চারণ করতে কজন পারে?
অতনুর নিজের কর্মস্থানের বাসা মনে পড়ল। শ্রীহীন লক্ষ্মীছাড়া সেই ঘর। ঘরও নয়, আশ্রয়ও নয়, শুধু আস্তানা। শুধু খাবার শোবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রাখবার নির্দিষ্ট একটা জায়গা মাত্র।
সেই লক্ষ্মীছাড়া ঘরে লক্ষ্মীর আবির্ভাবের স্বপ্ন কি কোনদিন দেখেছে অতনু?
মনে পড়ছে না। ঘর নিয়ে কোনদিনই কিছু ভাবে নি বোধহয়। শুধু একটা যান্ত্রিক নিয়মে দৈনন্দিনের ঋণশোধ করে এসেছে। যদি কোনদিন সেই শ্রীহীন ঘর মনকে বিমুখ করে তুলেছে, বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। হয়তো বা কোন সহকর্মীর ডেরায়।
ওর বিয়ের কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অনেকেই, অতনু হেসে ওড়ায়। বলে, মিলিটারীতে কাজ করলে বিয়ে করতে নেই।
কিন্তু সত্যিই কি অমিতার জন্যেই নিজের জীবনটাকে এমন অর্থহীন করে রেখেছে অতনু? সেই গতানুগতিক ব্যর্থপ্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দেবে এই ভেবে এসেছে?
কই, তেমন তীব্রতা তো কোনদিন অনুভব করে নি! অমিতার কথা ভেবে ভেবে তো উত্তাল হয়ে ওঠে নি তার দিন আর রাত্রি!
শুধু একটু বিধুর বিষণ্ণতা। শুধু একটু কোমল করুণা।
অমিতা যদি এতদিনে তার স্বামীপুত্রের সংসারে সুখে আনন্দে জ্বলজ্বল করতো, যদি এমন করে নিঃস্ব হয়ে না যেত, হয়তো অতনু নিজের কথা ভাবত। ভাবত, দূরছাই, এই লক্ষ্মীছাড়া জীবন আর সহ্য হচ্ছে না।
কিন্তু অমিতার দুর্ভাগ্য তার চিত্তকে মূক করে রেখেছিল। তার বেশি কিছু নয়। অতনু ভাবে, তবু আমি নির্বোধের মত ছুটে এলাম তুচ্ছ একটু লোভের আকর্ষণে!
কিন্তু কে জানত অমিতা এমন করবে।
৪. বেলা দশটার রোদ
বাইরে বেলা দশটার রোদ।
অতনুর বৌদি বললেন, কি গো ঠাকুরপো, আজ আর উঠবে না, চা-টা খাবে না নাকি?
এই যে উঠি। শরীরটা তেমন
অবনী ওদিক থেকে শুনতে পেয়ে বলে ওঠে, শরীর ভাল নেই, তা হলেই তো মুশকিল। আজ আবার ট্রেনে যাবে। ওদিকে আবার জগন্ময়বাবু এসে।
হ্যাঁ, সামনে কাকাবাবু আড়ালে জগন্ময়বাবু!
অতনু বেরিয়ে এল। কিছু প্রশ্ন করল না।
অবনীই আবার বলল, বলে গেলেন ওঁরা সবাই অফিসে বেরোচ্ছেন, কারুর ছুটি নেই। দীপু ছেলেমানুষ, তুমি একবার গিয়ে যেন ওঁর মেয়ের খোঁজ টোজ নাও। ডাক্তার হওয়ার জ্বালা। কর্তব্যের পরিধি বেড়েই চলে। কিন্তু হল কি মেয়েটার?
কি জানি। শেষ পর্যন্ত কি যে দাঁড়ায় বলা শক্ত!
অতনুর বৌদি বলে ওঠেন, আমার তো মনে হচ্ছে ওর আবার বিয়েথাওয়া দিলে রোগ সেরে যায়।
অতনু ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, আপনি কেন ডাক্তার হলেন না তাই ভাবছি। দেশের একটা মস্ত বড় লোকসান!
.
আজ শুধু মা!
আজ সমস্ত সংসারের উপর শান্তিবারি। আজ সারা বাড়িতে পবিত্রতার হাওয়া। আজ পাগলী নীচে নেমে এসেছে। খুঁজছে মাকে।