কিন্তু আজকের কান্নার বিষয়বস্তু বদলেছে না?
তীব্র করুণ সুরটা এই কথাই না বলছে-আমার মা কোথায় গেল গো! আমার মা! আমার মা মরে গেছে।
জয়াবতীর তৃষিত হৃদয় বুঝি সুধার সাগরে ডুবে যায়, লজ্জিত লাঞ্ছিত প্রাণ গৌরবের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
দেখুক! দেখুক এইবার সত্যই মেয়ের তার কালকের সেই পরপুরুষের জন্য ব্যাকুলতা নিতান্তই পাগলামী কি না। আজ সে কথা ভুলে গেছে সে। হয়তো অতনু যে কে, একথা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। বলবে–জানি না, চিনি না, আমি কি করে জানব?
প্রথম ডাকেই জেগে উঠেছিলেন জয়াবতী, কিন্তু সাড়া দেন নি। থাক আরও ডাকুক। অমিতার মা মা সকলের কানে যাক। শুনুক সবাই, দেখুক অমিতা সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে কিনা।
হ্যাঁ দেখল সবাই।
অমিতা তার মার হাতটা চেপে ধরে বলছে আমার মা মরে গেছে।
অমিতা, অমিতা রে, এই তো আমি। এই তো তোর সামনে বসে রয়েছি, এই তো তোর হাত দিয়ে আমার হাত ধরা।
অমিতা বোজা চোখ খুলে পাগলের হাসি হেসে বলে, আছে? আমার মা আছে?
জগন্ময় কাছে আসেন, এই যে মা, আমিও রয়েছি। আমরা সবাই রয়েছি।
অমিতা কান্না থামিয়ে বলে, তবে কেন ওরা বলল, তোর মা নেই, তোর মা মরে গেছে।
ওরা কারা অমিতা?
ওই যে কালো কালো বিচ্ছিরি লোকগুলো!
বিভীষিকা দেখেছে! বিভীষিকা!
বড়পিসিমা নীচু গলায় ছোট ভাজকে বলেন, পাগলের মাথার মধ্যে যে নরকের বিভীষিকা চলে। যমদূত এসে ডাঙস মারে, তপ্ত তেলে ফেলবার ভয় দেখায়, বলে তোর কেউ নেই, সবাই মরে গেছে।
তাই নাকি? নন্দাও নীচু গলায় বলে, কে বললে? কী করে জানলেন?
ওমা, শোন কথা! এর আবার বলাবলির কি আছে? চিরকেলে জানা কথা।
অগত্যাই নন্দাকে চুপ করে যেতে হয়। সত্যিই তো। চিরকেলে জানা কথা, চিরকালীনরা তো জানবেই।
জগন্ময় সকলের অলক্ষ্যে জয়াবতীকে বলেন, রাত্তিরে টের পেয়েছিল নাকি?
জয়াবতীও সকলের অলক্ষ্যে বলেন, না না, আমি তো ছাত থেকে নেমে এসে দেখলাম অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আশ্বস্ত হন জগন্ময়।
আজ অমিতার মা বাপকে আশ্বস্ত করার পালা।
আজ আর তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে নি নতুন বরকনে, বেরিয়েছে একটু ধীরেসুস্থে একটু সময় দিয়ে, তার পর এসে ভিড়ে মিশে গেছে।
জয়াবতী ডাকেন, আয় দীপু কাছে আয়, ছোড়দির কাছে বোস।
হয়তো এই ডাকের মধ্যে শুধুই কন্যাস্নেহ বিগলিত হয়ে নেই, আরও কিছু রহস্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। হয়তো নতুন বৌকে সমঝে দিতে চান জয়াবতী, আমার এই ছেলেটি কেবলমাত্র তোমার সম্পত্তি নয়। সকলের ভাগ আছে। আমার দাবী আছে।
দীপক এসে খাটের ধারে দাঁড়ায়।
অমিতা চেয়ে দেখ, দীপু তোর কাছে এসেছে।
হঠাৎ অমিতা মাকে অবাক করে দিয়ে হি হি করে হেসে বলে, আহা কী আশ্চয্যি কথাই বললে! দীপু আমার কাছে আসে না?
তবে কি অমিতা স্বাভাবিক হচ্ছে? কেটে যাচ্ছে হিস্টিরিয়ার কে? জয়াবতী কি সত্যনারায়ণের শিন্নি মানবেন?
বড় ননদের দিকে সরে আসেন জয়াবতী, কাল থেকে তো জ্ঞানে নেই, ঘোরে আছে। দেব দৈব কিছু করলে হত না ঠাকুরঝি?
ননদ সুযোগ ছাড়েন না।
উদাস মুখে বলেন, সে তো আমি সাতবার বলাবলি করছি। কিন্তু তোমাদের বিশ্বাস আছে কি নেই, তাই ভেকে গুটিয়ে আছি।
না না, তুমি যা করবে তাই হবে। আমার অপেক্ষা করবার কি আছে? কপালে একটা টাকা ছুঁইয়ে রাখবো? কালকের থেকে একটু যেন ভাল মনে হচ্ছে
কথা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা হয় না, একটু যেন ভাল মনে হওয়া রুগী শুধু সায়া আর ব্লাউস পরে পরনের শাড়ীখানা পায়ের তলায় লুটোতে লুটোতে খাট থেকে নেমে দালান ডিঙিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
কি হল?
কি হল মা?
অমিতা বলে, বিলেত থেকে আমার বর আসছে যে এরোপ্লেন চড়ে, দেখতে যাব না?
.
হিরণয় চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চা পরিবেশনকারিণীর দিকে তাকিয়ে তিক্ত স্বরে বলে, কী মনে হচ্ছে? সাজা পাগল?
মনে যাই হোক, মুখে অপ্রতিভের বিনয় টেনে এনে সেজগিন্নী বলেন, ক্রমশ তো পাকাপাকিই হয়ে উঠছে দেখছি।
না বুঝে সুঝে কারও সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়।
কারুর কাছেই মন্তব্য করতে যাইনি আমি, শুধু তোমার কাছেই
আমার কাছেও মনের সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ করা উচিত নয়।
আচ্ছা মনে রাখবো। খেয়াল ছিল না যে আমি এক মহাপুরুষের ঘর করছি।
বিজয় স্ত্রীকে ডেকে বলে, আজ আর অতনু অতনু করছে না, না?
লক্ষ্য করি নি। করছে না বোধহয়।
লক্ষ্য না করবার কি আছে? সকাল থেকে মা মা করছে। তখন হঠাৎ বীরেশ্বরের নাম করল।
তার মানে পাগলের শোভনতা-জ্ঞান ফিরেছে। অথবা এ একটা রঙের তুরুপ। অনেকগুলো পিট কুড়িয়ে নেওয়া গেল।
এ কথার অর্থ?
কিছু না। আমার কথার আবার অর্থ! দাড়ি কামাও গে, বেলা হয়ে গেছে। আজ তো আর ছুটি নেই!
কথাটা সত্যি, বাড়িতে বিয়ে বাবদ দুদিন ছুটি নিয়েছিলেন কর্তারা, আজ অফিস।
.
তোমার অফিস যাওয়া হবে না। জয়াবতী তীব্রস্বরে রায় দেন।
জগন্ময় মাথা চুলকে আমতা আমতা করেন। বড় আশা করছিলেন বাড়ির এই দমবন্ধকারী জটিল জাল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়বেন যেখানে খোলা হাওয়া, যেখানে জীবনের আরাম।
বললেন, আজ একবার না গেলে–আমার তো আবার ওদিকেও দুদিন কামাই হয়েছে।
হোক! আমি একা ওই উন্মাদ মেয়ে নিয়ে মরবো নাকি?
আহা বাড়িতে তো সবাই রয়েছে।
সবাই তো আমার কতই ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষা করছে!