অতনুদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, না রে, ভীষণ একটা কাজ ভুলে গেছি তাই।
আমি তো হেসেই উঠেছি।
কাজ ভুলে গেছেন তো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রাস্তায় কি কাজ?
অতনুদা খুব চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, না রে, মানে খুব দরকারি একটা নোট কলেজে ফেলে এসেছি, আবার যেতে হবে।
ওঁর কলেজ মানে তো মেডিক্যাল কলেজ! আমি হায় হায় করে বলে উঠলাম, আহা ইস! আবার অতটা যেতে হবে আপনাকে? তা অতনুদা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, তুই কোথায় যাচ্ছিলি?
বললাম খেলতে।
অতনুদা হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললেন, তবে যা, বিকেলবেলাই হচ্ছে আসল খেলবার সময়, এ সময়টা নষ্ট করতে নেই। এই যে আমার গাড়ি এসে গেছে, বলেই একটা বাসে উঠে বসলেন, যে বাসটা সম্পূর্ণ উল্টোমুখো। ওই বাসে কলেজ! আমি তো অবাক।
কি জানি হঠাৎ আমার কেমন সন্দেহ হল, ওই দরকারি নোট ফোট সব বানানো কথা! অন্য কোন ব্যাপার। তাই পার্কের দিকে যেতে যেতেও আমি ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলাম। আর দেখলাম ঠিক যা ভেবেছি! আমি সরে আসতেই সবে ছাড়া চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন অতনুদা।
তবে কি ভুলে ভুল বাসে উঠে পড়েছিলেন? ভাবলাম দাঁড়িয়ে। ওই যে মোড়ের কাছে স্টেশনারি দোকানটা আছে, যেখান থেকে আমি ঘুড়ি আর মার্বেল কিনতাম, সেই দোকানটার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি ছোড়দি নামল ছোড়দির বাস থেকে। আর যেন আলো জ্বলে উঠল ছোড়দির মুখে।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কোথায় বা অতনুদার দরকারি নোট, কোথায় বা কি! দুজনে দিব্যি গল্প করতে করতে চলে গেল বাড়ি থেকে উল্টো দিকে।
রমলা হেসে বলে, ইস কে বলছিল তোমাকে বোকা! গোয়েন্দাগিরি পর্যন্ত করেছ?
না সত্যি, কি রকম যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম সে দিন। ভাবলাম এটা কি হল! খেলতে মন লাগল না, একটু পরেই বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে দেখি মা ব্যস্ত হয়ে এ ঘর ও ঘর করছেন, অমিতা এখনো কলেজ থেকে ফেরে নি বলে। একবার ভাবলাম বলে দিই। বলে দিই–ছোড়দির আসার কথা। কিন্তু কেমন যেন পারলাম না। মুখে আটকে গেল। মনে হল মা আমাকেই খুব বকবেন। তার একটু পরেই ছোড়দি এল, আর তার কথা শুনে আমি একেবারে আকাশ থেকে আছাড় খেলাম। মা যেই বললেন, আজ এত দেরি কেন রে অমি? ছোড়দি অম্লান মুখে বলল, কলেজের লাইব্রেরীতে বই পড়ছিলাম মা!
সন্ধ্যেবেলা আমি ছোড়দিকে ধরলাম। হারে ছোড়দি, তুই মার সঙ্গে মিছে কথা বললি যে? ছোড়দি কপাল কুঁচকে বলল, মিছে কথা আবার কখন বললাম? আমি তখনকার কথা তুললাম। বললাম, তুই তো কলেজ লাইব্রেরীতে ছিলি না? ঠিক সময়ই তো এসেছিলি। অতনুদার সঙ্গে গল্প করতে করতে ওদিকে চলে গেলি। তবে কেন
ছোড়দি গম্ভীরভাবে বলল, সব কথা বড়দের বলতে হয় না। সব কথা ছোটদের শুনতে হয় না।
ছোড়দির ওরকম গম্ভীর মুখ বড় কখনো দেখি নি। তাই আর কিছু বলতে সাহস করলাম না। এই মাত্র একটা দিন। আর কখনো কোনদিন ওদের দুজনকে দাঁড়িয়ে একটু বেশিক্ষণ কথা বলতেও দেখিনি।
ওই একদিনেই তো সব দেখা হয়ে গেল। রমলা গম্ভীরভাবে বলে, ওঁরা কেন যে নিজেদের ভালবাসাকে প্রকাশ করলেন না, এ একটা অদ্ভুত রহস্য। নেহাৎ তো আর দেবদাস পার্বতীর যুগ নয়!
সেই জন্যেই তো বলছি, খুব একটা কিছু হলে–
মানুষ অনেক সময় নিজেকে চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না নিজের মনকে। না বুঝে আগে জীবনকে অবহেলা করে ওড়ায়, তারপর সেই জীবনের জন্যে পাগল হয়।
দীপক অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য, এত কথা কি করে জানল রমলা? ভাবল, ছোড়দি সহজ থাকলে বৌ দেখে কত খুসি হত! আর রমলাও ছোড়দিকে দেখে! তার ভাগ্যটাই খারাপ, তাই ছোড়দিকে রমলার সামনে মেলে ধরতে পারল না।
দীপক বোকা, দীপক গবেট কিন্তু দীপকের দিদি? দীপকের সেই দিদিকে রমলা কী মূর্তিতেই দেখল!
এ কথাও মনে হল দীপকের, আজ ছোড়দি এমন করে নিজেকে ছড়িয়ে ফেলল তাই রমলার সাধ্য হচ্ছে তার জীবনের নিভৃতে সন্দেহের সার্চলাইট ফেলবার, সাহস হচ্ছে তার প্রেম নিয়ে আলোচনা করবার। এমন না হলে রমলা ছোড়দিকে সমীহ করত, শ্রদ্ধা করত, হয়তো বা ভয়ও করত।
ছোড়দিকে যদি ভাল অবস্থায় দেখতে! নিঃশ্বাস ফেলল দীপক।
নিঃশ্বাস ফেলল রমলাও, আমার ভাগ্য! লোকে হয়তো আমাকেই অপয়া বলে নিন্দে করবে।
তোমায় নিন্দে করতে যাবে কেন? তোমার কি দোষ?
এ সংসারে আমার আবির্ভাব অশুভ।
এর পর আর ছোড়দির প্রসঙ্গ আশ্রয় পায় না, ভেসে যায় আদরের বন্যায়, আবেগের বন্যায়। দীপকের আদরিণী প্রিয়া নিঃশ্বাস ফেলবে!
অনেকক্ষণ পরে রমলা বলে, বিধবা বিয়েটা তো এখন আর নিন্দের নয়।
দীপক গম্ভীর ভাবে বলে, বিদ্যাসাগরের আমল থেকে। অন্তত বেআইনি তো নয়ই তখন থেকে।
গার্জেনরা ইচ্ছে করলেই, অথবা ওঁরা নিজেরা সাহস করলেই, এই মর্মান্তিক অবস্থার অবসান হতে পারে।
আর ওঁরা! দীপক নিঃশ্বাস ফেলে, ছোড়দি কি আর মানুষ রইল?
রমলা এ কথার উত্তর দিতে পারে না। ভাবে, তা সত্যি।
.
রাত্রিশেষের কোমল আলো ঘরে এসে ছড়িয়ে পড়ে, মধুর জাগরণে ক্লিষ্ট দুটি তরুণ তরুণী সচকিত হয়ে বলে, এ কী, ভোর হয়ে এল নাকি?
তাই তো দেখা যাচ্ছে। ইস ঘুমোও, ঘুমিয়ে নাও একটু।
কোথা দিয়ে যে রাতটা কেটে গেল!
সত্যি কী এত গল্প করলাম! শুধু তো সেই
কথা শেষ হবার আগে সচকিত হয়ে উঠল ওরা ঠিক কালকের মত সেই তীব্র তীক্ষ্ণ ভাঙা গলার করুণ কান্নায়। যে কান্না শুনে ঘরে ঘরে দরজা খুলে গিয়েছিল।