কিন্তু আজ যদি জয়াবতী সেই তাঁর ভগবানের প্রতাঁকের কাছে পরামর্শ নিতে না আসতেন! যদি নিজের বুদ্ধিতে চুপিচুপি অতনুর কাছে বলতেন, বাবা অতনু, অমিতা তোমার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী, তোমার স্নেহের পাত্রী
তা হলে কি এ কাহিনীর ইতিহাস আলাদা হত না? কিন্তু জয়াবতী জগন্ময়ের পরামর্শ নিলেন–বুদ্ধি বিবেচনার পরিধি যাঁর বারো বছরের ছেলেটার থেকে খুব বেশি নয়।
.
কয়েকখানা বাড়ি পরেই আর একটা ছাতে শতরঞ্চ বিছিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে জেগে পড়ে ছিল এ কাহিনীর নায়ক। এঁদের আলোচনার ছন্দাংশও তার কানে গেল না।
বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে নাকি জগতের সব শব্দই অক্ষয় হয়ে থাকে, কোথাও হারায় না। শুধু উপযুক্ত যত্ন থাকলেই ধরে ফেলা যায় সে শব্দকে। কোথাও কোনখানে যদি বসানো থাকত সে যন্ত্র! তাহলে কি পরদিন–
হ্যাঁ, পরদিনের কথাই ভাবছিল অতনু।
চলে যেতে হবে।
চলে যাওয়া ছাড়া উপায় কি? থেকেই বা কি করবে?
স্নেহ দিয়ে সেবা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে ওকে কি সুস্থ করে তুলতে পারবে অতনু? সে অধিকার কি আছে ওর?
না, অধিকার না থাকলে কোন মহৎ কর্মও করা যায় না।
.
গত রাত্রে ফুলশয্যা তো না হওয়াই। আজ তবু ওরই মধ্যে একটু সকাল সকাল বরকনে ঘর পেয়েছে। আজ সবিতা তার প্রায় সমবয়সী দাদাকে একটু ঠাট্টাও করে গেছে। আর আজ বহিরাগতরা অনেকেই চলে গেছেন বলে বাড়িটাও কিঞ্চিৎ হালকা লাগছে।
তবু প্রথম মিলনোচ্ছ্বাসটা কেটে গেলে, কথায় কথায় সেই ভারী প্রসঙ্গটাই এসে পড়ে। যে ভয়ঙ্কর ভারে কাল থেকে বাড়িখানা হাঁপিয়ে উঠেছে।
গানের সময় ছোড়দি কিন্তু খুব শান্ত হয়েছিল তাই না?
রমলা দুষ্টুমী করে বলে, তা ছিলেন, কিন্তু ছোড়দির ভাই ভ্যাবাগঙ্গার মত যা হাঁ করে গান শুনছিল, দেখে হাসি চাপা দায় হচ্ছিল।
তার মানে? আমি ভ্যাবাগঙ্গার মত বসেছিলাম?
তবে না তো কি? ক্যামেরা থাকলে ফটো তুলে রাখা যেত।
কিন্তু সত্যি, ছোড়দির ওপর তোমার গান খুব প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। কী চুপ করেই
তোমার ধারণা গানের প্রভাবে? রমলা বলে।
তবে?
সাধে বলি গবেট! প্রভাবের উৎস আলাদা, বুঝলে?
না না, তুমি যা ভাবছ, মোটেই তা নয়।
নয় মানে? মেয়েদের চোখ কখনো ভুল করে না, বুঝলে? তোমার অতনুদা এবং ছোড়দির মধ্যে রীতিমত একটি গভীর ভালবাসা ছিল।
ছিল সামথিং, তবে গভীর টভীর কিছু নয়।
নয়, তোমায় বলেছিলেন?
আহা বলবার কি আছে? এই তো বিয়ের আগে যখন অতনুদার নামে নেমন্তন্ন চিঠি পাঠানো হল, ছোড়দি ছিল তো কাছেই, কোন চাঞ্চল্য দেখি নি। তা ছাড়া কাল যখন অতনুদার আসার খবর দিলাম, গ্রাহ্যই করল না ছোড়দি।
সাধে বলি জান না! গভীর সমুদ্রই ওপরে শান্ত, বুঝলে? কিন্তু তরঙ্গ যখন ওঠে, তখন জাহাজ ডোবায়, পাহাড় ভাসায়।
এই বয়সে এত কথা শিখলে কি করে?
মেয়েদের আবার কথা শেখবার জন্যে বয়েস বাড়বার দরকার হয় নাকি?
উঃ বাড়িসুদ্ধ লোক এই বৌকে বলছে, কী শান্ত, কী ঠাণ্ডা, কী ভালমানুষ!
শান্ত ঠাণ্ডা বলে বুদ্ধি থাকবে না?
কিন্তু বুদ্ধির জোরে যতটা ভাবছ, ঠিক তা নয়। ডাক্তার তো বলে গেল, এ রকম ক্ষেত্রে হঠাৎ এক একজনের ওপর ঝোঁক হয়।
যা শুনতে ভাল, ডাক্তাররা তাই বলে।
বাঃ তুমি একদিন দেখেই যে অনেক কিছু আবিষ্কার করছ? আমি দেখছি না চিরকাল?
চিরকাল মানে তো তোমার বারো বছর বয়েস অবধি? বললে না, অতনুদা যখন চলে গেছলেন তখন তোমার বয়েস মাত্র তেরো?
তেরো নয় মোটেই, চৌদ্দ।
রমলা হেসে ওঠে, উঃ একেবারে আকাশ পাতাল তফাৎ। একটা চৌদ্দ বছরের ছেলে! মানে হাফপ্যান্ট পরা খোকা। তার ওপর আবার তোমার মত গবেট। তোমার চোখে ধুলো দিয়ে কত রহস্য পার হয়ে যেত, সে এখন আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
তা পাবে বইকি। চক্ষু দুটি দিব্য কিনা! অতনুদা তো এসে বেশির ভাগই বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে কি কাকাদের সঙ্গে কথা বলে চলে যেতেন।
হু, তার মানে বাবার সঙ্গে বা কাকাদের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ওঁর প্রাণ অস্থির হয়ে উঠত, তাই ছুটে আসতেন কি বল?
বাঃ তার কি মনে আছে? বরাবর এসেছেন ছেলেবেলা থেকে
ও যুক্তি অচল! এ বাড়ি ওঁকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতো, বুঝেছ?
ক্রমশ সবই বুঝছি। মানে যে ভাবে বোঝাতে সুরু করেছ তুমি! তবে হ্যাঁ, আমি তো একেবারে অস্বীকার করছি না। হাঁদাই হই আর খোকাই হই, একেবারেই যে কিছু বুঝতাম না তা নয়। তবে কিনা তোমার ওই গভীর টভীর? কই? হয়তো অতনুদা চলে যাবার সময় ছোড়দিকে দেখতে পেল, বলে উঠল ইস, তুমি যে রীতিমত একটি মহিলা হয়ে উঠেছ। আর দেখাই পাওয়া যায় না।
রমলা উঠে বসে বলে, আর উত্তরটা?
না না, অমন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসবার মত কিছু নয়। ও রকম কথায় ছোড়দি হয়তো বলতো, বাঃ বাড়িতেই তো থাকি। যখন কলেজে যাই তখন আসো তা হলে?
এই? শুধু এই?
তবে আবার কি।
আর তোমাকে দিয়ে কখনো কিছু বলে পাঠাতেন না?
আমাকে দিয়ে? আমাকে দিয়ে কেন?
তোমার মত হাঁদা মার্কাদের দিয়েই ওই রকম কাজ করানো যায় কিনা!
দীপক একটু চুপ করে থেকে বলে, আমাকে দিয়ে? নাঃ তা কোনদিন নয়। যদি বললে, তবে একদিনের কথা মনে আছে। যেদিন আমারও একটু খটকা লেগেছিল।
শুনি শুনি। দেখি তোমার বুদ্ধির বহর।
এমন কিছুই না। তবু–মানে আর কি, সেদিন বিকেলে পার্কে যাচ্ছি খেলতে, দেখি অতনুদা ওই মোড়ের বাস স্টপেজের কাছে দাঁড়িয়ে। বললাম, কি অতনুদা, কলেজ থেকে ফিরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যে? বাড়ি যাবেন না?