আহা তা বলে মাইনে করা লোক।
মাইনে করা লোকের দৌরাত্ম্যি তো চব্বিশ ঘণ্টাই সইতে হচ্ছে। আমার মুখ চাইতে মেয়েটা ছিল, তাও ভগবান মারলেন। তা হ্যাঁ গো, ডাক্তার ঠিক কি বললেন বল দিকি? ওই জিজ্ঞেস করতেই আরও তোমার কাছে আসা। কোনখানে তো একদণ্ড নিরিবিলি নেই।
আবেগের মুখে ছাতের কাপড়ের অজুহাতটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হন জয়াবতী।
জগন্ময় অবশ্য মনে পড়িয়ে দিয়ে লজ্জায় ফেলেন না। শুধু বলেন, ওই তো তখন বললাম। বলেছেন সেরে যাবে।
সেরে যাবে বললেই সব হল? কবে সারবে তা কিছু বলবে তো?
তা কি আর সঠিক বলা যায়?
তবে আর কিসের ডাক্তার? বলছিলাম মহারাজজীকে একবার জানানো হোক।
জগন্ময় নীরস স্বরে বলেন, ওঁকে আর জানিয়ে কী হবে? এখন ওঁর অনেক বড় বড় শিষ্য হয়েছে, হাইকোর্টের জজ পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, যত সব আগরওয়ালা ঝুনঝুনওয়ালারা সোনার খড়ম, রূপোর সিংহাসন গড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতন চুনোখুঁটিদের কথায় কি আর মন দেবার অবকাশ আছে?
কথাটা জয়াবতীরও মনের কথা। তবে কি না জগন্ময়ের মত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে সাহস হয় না তার। ইতস্তত করে বলেন, বড়দি একটা কবচের কথা বলছিলেন, আমার কিন্তু বাপু সাহস হয় না।
কেন, এতে আর সাহসের কী আছে?
কি জানি কার মনে কি আছে, হিতে বিপরীত হবে কিনা! অমির বিয়েতে বড়দিই তো ওঁদের জ্যোতিষী দিয়ে কুষ্ঠি মিলিয়ে দিয়েছিলেন! বলেছিলেন রাজঘোটক হয়েছে।
সত্যটা নির্ভেজাল।
জগন্ময় গভীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলেন, সবই আমাদের ভাগ্য!
তা ছাড়া আর কি! এখন ভাবছি তখন যদি অতনুর সঙ্গেই দিতাম!
আর ও কথায় কাজ কি?
কাজ না থাকলেও সে কথা লোকে বলে। পশ্চাত্তাপ করাই মানুষের রীতি। তাই জয়াবতী বলেন, মেয়ের মন তো আমি বুঝতাম। বলিনি তোমাদের কাছে, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেছিলাম অনেকবার, কিন্তু ওই যে কেমন মনে হল নেহাৎ পাড়াপড়শীর মধ্যে, আজন্ম দেখাশোনা, লোকে বলবে লভের বিয়ে, তাতেই মন সায় দিল না। তাছাড়া তখন আর কে ভেবেছে বিদেশে চলে যাবে, অমন চাকরি পাবে! এখানে তো ওই, না চাল না চুলো। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলেন জয়াবতী।
জগন্ময়ও সে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেশান। বলেন, তুমি না বলল, ধরতে কি আর আমিই পারতাম না? তবে ওই যা বললে, একেবারে ঘরের ছেলের মত! আর ওর চেয়ে দশগুণ ভাল পাত্র পেয়েও গেলাম। আমাদের দুর্ভাগ্যে ওরকম হয়ে গেল তাই। নইলে বীরেশ্বর বেঁচে থাকলে কি আর আজ অতনুকে পুঁছতে অমি?
কি জানি! মেয়েমানুষের মন জয়াবতী নিজেও যে মেয়েমানুষ-জাতীয়া সে কথা বিস্মৃত হয়ে বলেন, স্বর্গ ছেড়ে পাতাল চায়। তা সেও তো রইল না। সেই তখনই যদি কথাও তো হয়েছিল– বিয়ে কথাটা আর উচ্চারণ করেন না জয়াবতী, ওটা এড়িয়েই বলেন, তখন হয়তো অতনুকে বললে রাজী হয়ে যেত!
তা হত! জগন্ময় সায় দেন, ইয়ংম্যান ওরা তো আর প্রেজুডিসের ধার ধারে না। তা ছাড়া মেয়েটাকে স্নেহও করত।
তা হ্যাঁগা এইবার আসল কথা পাড়েন জয়াবতী, এখন আর হয় না?
এখন? জগন্ময় ক্ষুব্ধ হাস্যে বলেন, তুমিও কি মেয়ের সঙ্গে পাগল হলে? এখন ওকথা বলব কোন্ মুখে? ও এখন একটা অত বড় অফিসার, কত ভাল ভাল পাত্রীর বাবা ছুটে আসবে, এখন আমি বলব, তুমি আমার পাগল ছাগল বিধবা মেয়েটাকে বিয়ে কর!
যুক্তিটা অকাট্য। জয়াবতী চুপ করে যান।
হ্যাঁ, এই ভাবেই মানুষ অপরের মনের হিসেবনিকেশ করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। তাছাড়া
আর করবেই বা কি! নিজের বুদ্ধির পরিধি ছাড়িয়ে কে কবে ভাবতে পারে?
তবু জয়াবতী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা সেই অবধি তো বিয়েও করল না।
করল না ওর দাদা বৌদির চেষ্টা নেই বলে। আর বাংলা দেশের বাইরে অনেকদূর চলে গেছে!
আরও খানিক ইতস্তত করে জয়াবতী বলেন, আমি ভাবছিলাম চুপি চুপি একবার বলে দেখব।
ক্ষেপেছ! অমন কাজও কোর না। জগন্ময় হাঁ হাঁ করে ওঠেন, কী ভাববে তোমায়? তাছাড়া কালই তো চলে যাচ্ছে।
যাচ্ছে বলেই তো! জয়াবতী বলেন, যাওয়াটা আটকাতাম।
না না, ওসব করতে যেও না। কার কান থেকে কার কানে যাবে। লোকে হাসবে। শুধু একটা কেলেঙ্কারী! অতনুর যদি তেমন ইয়ে হত, নিজেও তো সে প্রস্তাব করতে পারত? অমি বিধবা হবার খবর পেয়ে একটা চিঠিও তো দেয় নি। ও বাড়ি থেকে খবর কি আর পায় নি?
এ যুক্তিটাও অকাট্য।
জয়াবতী নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মনকে মানিয়ে নিয়ে ঘরসংসারে মন ঢেলে শান্ত হয়ে ছিল সে এক! এখন ওই ভয়ঙ্করকে অহরহ কী করে চোখের ওপর সইব? আর কি করেই বা সামলে বেড়াব?
ভাগ্য! যাও শুয়ে পড়গে। আবার জেগে উঠে কিছু করে বসবে।
আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো, তুমি ভুগো মেয়ে নিয়ে। বলে কাদো কাঁদো হয়ে উঠে দাঁড়ান জয়াবতী।
জগন্ময় অনুনয়ের ভঙ্গিতে একটা হাত বাড়িয়ে হাত ধরে বসান। বলেন, অবুঝ হয়ে আর কি করবে? দেখ ডাক্তার তো বলছে ভাল হয়ে যাবে।
আমার কপালে আর হচ্ছে!
মন খারাপ কোর না। একটু বরং এখানে হাওয়ায় গড়িয়ে নিয়ে যাও।
নাঃ! বলে একরকম অভিমানভরেই ধপ ধপ্ করতে করতে নেমে যান জয়াবতী। দোষ ভাগ্যের, জগন্ময়ের উপর অভিমানের কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু বাঙালীর মেয়ে স্বামীকে ভাগ্য ভগবান সব কিছুর প্রতীক ভাবতেই অভ্যস্ত। তাই নিঃসঙ্কোচে দায় দোষ সবই সেই বেচারার ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।