জগন্ময়ের বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, জগন্ময়ের একটা মেয়ে মারা গেছে, একটা মেয়ে শুধু বিধবা হয়েও রেহাই দেয় নি, আবার পাগল হয়ে উঠে বাপ-মার মাথায় বাজ হেনেছে, জগন্ময়ের ছেলে বিয়ে করে প্রেমের পাঠ সুরু করেছে, এ সবই সত্যি, তবু তিরিশ বছরের অভ্যাসটাও বড় বেশি সত্যি।
তিনি চৌকিতে শুয়ে নাক ডাকান, এবং জয়াবতী মেঝের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সংসারের অপর সদস্যদের মধুর সমালোচনা স্বামীর কর্ণকুহরে ঢালবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত চিত্তে মশা চাপড়ান আর ছারপোকা মারুন তাতে কিছু এসে যায় না তার। চিরঅভ্যস্ত উপস্থিতিটুকুই নেশার মত। তার অভাব ঘটলে কিছুতেই যেন কেমন স্বাচ্ছন্দ্য আসে না।
অমিতার বৈধব্যের পর প্রথম প্রথম কিছুদিন জয়াবতী আপন শয়নমন্দির ছেড়ে ওপাশের ঘরে শয্যা বিছিয়েছিলেন, মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে ব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। অমিতাই বাতিল করে দিয়েছিল।
বলেছিল, তুমিও নাক ডাকায় বাবার থেকে কম যাও না, আমার ঘুম হয় না। নিজের জায়গায় যাও বাপু, তোমার ঢোলের বাজনা ঢাকের বাদ্যির নীচে ঢাকা পড়বে।
আশ্চর্য, নাক ডাকার মত অসহ্যতম অপবাদেও জয়াবতী রেগে ওঠেন নি, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন নি। শুধু অপ্রতিভ মুখে বলেছিলেন, শোনো কথা মেয়ের! আমার বলে সারারাত ঘুমই আসে না!
ও বাবা, না আসতেই এই! এলে কী হত! আমার তো ওতেই ঘুম ঘোচে। আমি একাই বেশ শোব।
তাই রেখে কখনো আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? বলেছিলেন জয়াবতী প্রত্যাশার শ্বাস চেপে।
বেশ তো, সবিতা শোবে আমার ঘরে।
রক্ষে কর! সেজগিন্নীর মেয়ে! সে ব্যবস্থা করলে সেজগিন্নী এখন কত অস্বস্তি করবে কে জানে। তোর সারারাত পাখার হাওয়া খাওয়া অভ্যেস, ওর ছেলেমেয়েদের ঠাণ্ডালাগার ধাত।
ঠিক আছে, খোকন শোবে।
খোকন অমিতার নিজের ভাই, জয়াবতীর সম্পত্তি, তার ওপর জোর চলে। অতএব সেই ব্যবস্থাই বহাল হল। এতদিন তাই চলে আসছিল। কিন্তু আবার যে অমিতা বিরাট এক সমস্যা হয়ে উঠেছে! আর তো অন্য কোন ব্যবস্থাই শোভন নয়। এখন থেকে যেটেরা পূজোর রাতের ঘর আগলানোর মত জেগে বসে আগলাতে হবে অমিতার ঘর। আর সে কাজ কে করবে, মা ছাড়া?
রাত্রে শুতে এসে সেই কথাটাই মনে পড়ল জগন্ময়ের। বুকের ভিতরটা খালি খালি ঠেকল। ঘরের মধ্যে প্রাণ হাঁপিয়ে এল। দেয়ালের কোণ থেকে দাঁড় করানো মাদুরটাকে টেনে উঠলেন ছাতে। আর বেশ শোরগোল করেই উঠলেন। বোধকরি অপ্রতিভতাটাকে ঢাকতে। কেউ কিছু মনে করত না, তবু জগন্ময়ের মনে হল সবাই বুঝি অনেক কিছু মনে করবে।
জয়াবতী মেয়ের ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে মৃদুনীল আলোটা জ্বালালেন, মেঝেয় নিজের বিছানাটা পাতলেন, পাখাটা রেগুলেটারের শেষ অঙ্কে ঠেলে দিলেন, কিন্তু সমস্ত দিনের কর্মক্লান্ত দেহটাকে ঝুপ করে ফেলে দিলেন না, মিনিট দুই ঘুরিয়ে নিয়েই বেড়ালেন এ জানলা থেকে ও জানলায়। তারপর সহসাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিথর ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, ছাতে বোধহয় ছিষ্টির কাপড় মেলে দেওয়া আছে। হরি কি আর তুলেছে! যা বাবু হয়েছে আজকাল! যাই দেখি গে, রাতে যদি আবার বৃষ্টি আসে! আমারই হয়েছে যত জ্বালা!
আস্তে আস্তে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে। মোটা মানুষ! তবে দিনের বেলায় রোদের সময় সিঁড়ি উঠতে যতটা হাঁপ ধরে, রাতে ততটা নয়।
.
ঘুমোলে নাকি? মাদুরের এক প্রান্তে বসে পড়ে এই অহেতুক প্রশ্নটি করলেন জয়াবতী।
কৃতাৰ্থমন্য জগন্ময় ব্যস্তে পা গুটিয়ে নিয়ে উঠে বসলেন। চুপি চুপি বললেন, কাকে রেখে এলে?
রাখব আর কাকে? জয়াবতী আঁচল তুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। মনে হল সন্ধ্যেবেলা বুঝি ছাতের কাপড় তোলা হয়নি। রাতে যদি বৃষ্টি ঢালে! তা দেখছি হরিবাবু তুলেছেন দয়া করে।
না, এ বয়সে সত্যি কথাকে স্বীকার করা যায় না। পরস্পরের কাছেও নয়। বলা যায় না তোমার জন্যেই এলাম। তোমার কথা ভেবেই এলাম।
অতএব সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
কেউ কিছু বলবে না তো?
প্রায় তিরিশ বছর আগের শঙ্কিত বুক নিয়েই বললেন জগন্ময়।
বলবে আবার কি! জয়াবতী শঙ্কাকে অস্বীকার করার ভঙ্গিতে বলেন, মার চেয়ে দরদী, তারে বলে ডান! এই যে হল, এ কার গেল?
জগন্ময় করুণস্বরে বললেন, গেল বলছ কেন? ডাক্তার তো বলেছে–ও কিছু না, দুচার দিনের মধ্যে সেরে যাবে।
লোকের হলে সারতো। আমার ভাগ্যে নয়। কপালখানি তো দেখছি! কী যে করব আমি ওই মেয়ে নিয়ে! একে তো শত্ৰুপুরীর মধ্যে বাস!
শত্ৰুপুরী আবার কি?
একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন জগন্ময়।
তুমি আর কী জানবে? পুরুষমানুষ বাইরে বাইরে থাক। কাল অতনুকে একটু ডেকেছিলাম, তাতেই আজ সংসারে কত কথা! তোমার বড়দি তো আমাকে মিঠে মিঠে করে একশো কথা শোনালেন।
তুমি একথা বলতে পারলে না, অতনু ডাক্তার! রোগ বিপদের সময় লোকে ডাক্তারের বয়েস দেখবে?
বলতে কি আর ছেড়েছি? বলেছি সবই। তবু সেজগিন্নীতে আর ওঁতে চোখ ঠারাঠারি হয়ে গেল। আর ওই বামুন মেয়েটিও কম নয়। ওটিও একটি দেইজি।
বিদেয় করে দিও। বলে কর্তার কর্ম সমাপন করেন জগন্ময়।
জয়াবতী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, তোমার আর কি, বলে খালাস। ম্যাও সামলায় কে?