হঠাৎ বুঝি পাগলিনীর গভীর ঘুমের পর্দাটা ছিঁড়ে যায়, আর সদ্য জাগরণের চেতনা এক করুণ অভিব্যক্তির মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মৃদু গুঞ্জরণে কাঁদতে থাকে সে বালিশে মুখ গুঁজে।
অতনু একটু কাছে সরে গিয়ে বলে, এই দেখতে হবে জানলে কে আসত?
কান্নার বেগ আরও বাড়ল, ফুঁপিয়ে উঠল পাগলিনী, আমাকে শুধু বকল! ভালবাসল না আদর করল না।
অমিতা, তুমি এমন করছ কেন? ভারী গম্ভীর শোনায় অতনুর গলা। কিন্তু অমিতা এই সহজের সম্বোধনে সাড়া দেবে কি করে? অমিতার বুদ্ধির গোড়ায় যে শনি আশ্রয় করেছে। বিকৃত করে দিয়েছে সে বুদ্ধিকে। তাই সে বালিশে মুখ গুঁজে চাপা বিকৃত স্বরে বলে, চলে যাবে কেন? যারা এসেছে তারা চলে যাবে কেন? তারা থাকবে।
না, কেউ থাকবে না। তুমি সহজ না হলে, ঠিক না হলে, কেউ থাকবে না।
ওরে বাবারে, আমার অসুখ করেছে তবু আমার মনে কষ্ট দিচ্ছে। অমিতার ছড়ানো চুলগুলো বালিশে ঘষটে ঘষটে চামরের মত হয়ে ওঠে।
অমিতা, তুমি ইচ্ছে করলেই ভাল হয়ে যেতে পারো। অসুখ সারিয়ে ফেলতে পারো।
না না না! ইচ্ছে করব না।
বেশ কোর না। আমি তাহলে যাচ্ছি।
যাবে না, যাবে না। হঠাৎ উঠে বসে অমিতা, তুমি থাকবে, একশো দিন পঞ্চাশ দিন থাকবে।
থাকতে পারি। অতনু কয়েক মুহূর্ত সেই পূর্ণ উন্মাদিনী মূর্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, একশো দিন নয়, আর একদিন থাকতে পারি, যদি দেখে যেতে পাই তুমি সভ্য হয়েছ শান্ত হয়েছ।
কে জানে কি উত্তর দিত সেই আরক্ত নয়ন, উড়ন্ত-চুল, উপবাসে শীর্ণ মেয়েটা! বাধা পড়ল। সেজগিন্নী কখন যেন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকে বলেন, অতনু, দিদি বলছেন তুমি বাড়ি যাবার আগে তোমার রুগীকে কিছু খাইয়ে যাও।
অতনু তার দিকেও একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর ঈষৎ অবহেলাভরে বলে, আপনারাই ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ান। আমার কথা শুনছে কে? তাছাড়া আমার আর দেরি করার সময় নেই। গোছগাছ আছে। সারাদিনটা তো এলোমেলো করে কেটে গেল।
তবু যাই তুমি আজ ছিলে, তাই যদি বঠাকুর একটু নিশ্চিন্ত ছিলেন। তুমি চলে যাবে, এই মেয়ে নিয়ে যে কী হবে! ভারী দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন সেজগিন্নী।
আমি আর কী করতে পারলাম!
ওঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতনু বলে, তবু সন্ধ্যেবেলা এ ঘরে গানটান গাইয়ে কিছুটা সহজ করবার চেষ্টা করছিলাম।
সেই তো!
সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তুমি যতটা বুঝবে, ততটা কি আর আমরা বুঝব? যাক তাহলে দুধ একটু আনি?
অতনু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যভরে বলে, আনুন, খাওয়ান, যা পারেন করুন। আমার নিজের ওপর কোন আস্থা নেই। দেখছেন না, খাওয়ার নামেই দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অতনু।
পথে বেরবার মুখে জগন্ময় হতাশভাবে বলেন, চলে যাচ্ছ বাবা?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কোন উন্নতি দেখলে না?
মনে তো হচ্ছে। অতনু ইচ্ছে করেই একটু আশ্বাস দেয়, হয়ে যাবে, দুএকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারকে আর জানানো হয়েছিল?
বিকেলে চেম্বারে ফোন করেছিলাম। উনিই ওই কথাই বললেন। ঠিক হয়ে যাবে। বললেন সাময়িক। আর বললেন–।
জগন্ময় একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, ডাক্তারের ধারণা অল্প বয়সে এমন অবস্থা হলে, মেয়েরা একটু বেশি অভিমানী হয়ে যায়। হয়তো হঠাৎ কারও কোনও কথায় আহত হয়েছে, শক খেয়েছে। কিন্তু ওকে তো বাবা কেউ কিছু বলি না। সবাই সব সময় ভাল কথা বলি।
সেটাও সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়। অতনু বলে, তাতে মনে হয় সবাই আমায় করুণা করছে। একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন। ভালর সময় ভাল, বকার সময় বকা
ও কি আমার বকবার মত মেয়ে অতনু? জগন্ময় মেয়েমানুষের মত কেঁদে ফেলে কোঁচার খুঁটে চোখ মোছেন।
মানুষটাকে মমতা করে অতনু। কিন্তু মৌখিক সান্ত্বনা আর জোগায় না, তাই বিষণ্ণ ভাবে বলে, আচ্ছা তবে আসি।
কালই তো চলে যাচ্ছ? গলা ঝেড়ে বলেন জগন্ময়।
না, কাল আর যাওয়া হল কই? প্লেনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে চলে যায় অতনু।
সরল মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে বিবেকে বড় পীড়া দেয়। সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যায়।
.
সবাই ভাবছে। যে যার নিজের রুচি প্রকৃতি ধারণা অনুযায়ী ভাবছে।
অমিতার এই অসুখটা যেন গোলকধাঁধার ঘুরন্তপথে ছেড়ে দিয়েছে সবাইকে।
কিন্তু অমিতা নিজে?
অমিতা কি ভাবতে পারছে? ভাববার ক্ষমতা কি আছে অমিতার?
তা মস্তিষ্ক তো কখনও চিন্তাশূন্য হয় না। সে যদি বিকৃত হয়ে যায় তো, বিকৃত চিন্তাই করে। সেই বিকৃত চিন্তার পথেই ঘুরপাক খেতে থাকে তার অসামাজিক বাসনা।
ওকে আমি যেতে দেবো না। যা ইচ্ছে করে যাওয়া বন্ধ করব। ও থাকুক, আমার কাছাকাছি থাকুক। ওকে না দেখে কী করে ছিলাম আমি? ওকে না দেখে কী করে থাকব!
.
ঘরে ঘরে পাখা আছে, তবু জগন্ময় মাদুর হাতে করে ছাতে উঠলেন। বাড়ির অনেককে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, উঃ কী অসম্ভব গুমোট! ঘরে তো টেকা যাচ্ছে না। ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছিল না?
হ্যাঁ, ছাতটা আজ ধোওয়া হয়েছে বইকি। আলাদা বকশিশ কবুল করে নতুন চাকরকে দিয়ে ধুইয়েছেন জয়াবতী।
দেখি ছাতেই যাই, যদি একটু ঘুম আসে। বলে চলে গেলেন জগন্ময় গলাটা একবার ঝেড়ে।
কিন্তু সত্যিই কি আর ঘুম আসার জন্যে এত ঘটা করে ছাতে ওঠা?