ওরে বাবা! অতনু বিষণ্ণতার উপর সূক্ষ্ম একটু হাসির চাদর বিছিয়ে দেয়। বলে, রাইট নিয়ে তেড়ে গিয়ে অন্ধ তমসাচ্ছন্ন চিত্তে লাইট জ্বালাতে গেলে ভীষণ ফাইট হয়ে যাবে।
অতনুর কথার ধরনই এই।
একমাত্র বাড়িতে বৌদি বাদে সমান সমান সকলের সঙ্গেই সে পরিহাসে সরস করে কথা বলে।
দীপক ম্লান মুখে বলে, এখন মনে হচ্ছে, এই গরমে এই সব বিয়ে ফিয়ের ব্যাপার না। বাধালেই হত। গরমে বেশি খেটেখুটেই তো এইটি হল!
অতনু বলে, থামো বিবেকী পুরুষ! আর আত্মঅপরাধের ভারে পীড়িত হতে হবে না।
আর মনে মনে বলে, সে পীড়ন যে ভোগ করবার সে করছে। বলে, আমিই মূল, আমিই কারণ!
কিন্তু ওদিকে কান্নার সুর ক্রমেই করুণতর হচ্ছে।
নাঃ বিপদ করলে!
উঠল অতনু, বলল, চল দেখি।
এ ঘরের দরজায় তখনো সপ্তমাশ্চর্য দর্শনার্থীর ভিড়।
অতনুকে পৃষ্ঠবল করে দীপক বলে, এই দেখ, আবার সবাই এখানে গোলমাল করছ? অতনুদা বলছেন, ডাক্তার বলে গেছে চুপচাপ থাকতে দিতে।
অতনু উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে বেশ উচ্চবরোলে বলে ওঠে, আমি কিছু বলিনি রে বাবা! শুধু বলছিলাম অতদূর থেকে ছুটে এলাম তোর বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে, তা সে তো ডকে উঠল, তোর গায়িকা বৌয়ের দুখানা গানটানও যে শুনব, হিংসুটি অমিতা তার আদায় রাখল না।…মিছিমিছি কেঁদে বাড়ি মাথায় করছ কেন বল তো অমিতা? তার থেকে সুস্থির হয়ে বসে নতুন বৌয়ের গান শোন না।
অতনুর এই চড়াগলায় বুঝি কাজ হয়, পাগলীর কান্না থামে। সে ভাঙাগলায় বলে, আমায় কি কেউ গান শোনায়? আমায় শুধু ভয় দেখায়, বলে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে।
অতনু গম্ভীর ভাবে বলে, সেটা অনেক দিন সারা হয়ে গেছে। এক জন্তু দুবার বলি হয় না।…যা দিকি দীপু, তোর বৌকে–এই যে মাসীমা, আপনার বৌমাকে একবার ডাকুন দিকি, একটা গান শোনা যাক।
জয়াবতী শঙ্কিত দৃষ্টিতে নীচু গলায় বলেন, এ ঘরে?
হ্যাঁ, এ ঘরেই তো। অতনুর কণ্ঠস্বর প্রবল। গান শুনলে মন ভাল হয়।
কৃতাৰ্থমন্য দীপক ছোটে বৌয়ের বাজনাটা এনে হাজির করতে। আর ভাবতে ভাবতে যায়, চিরদিন শুনে এসেছি নারী মমতাময়ী, নারী করুণাময়ী, কি বাজে কথাই শুনে এসেছি! দয়া মায়ার কিছু যদি ওদের মধ্যে থাকে! মায়া মমতা করুণা সহানুভূতি যেটুকু যা আছে পৃথিবীতে, ওই পুরুষ মানুষের মনের মধ্যেই আছে।
এই গানের প্রস্তাব কোন মহিমময়ীর রসনা থেকে উচ্চারিত হত?
নতুন বৌ কুণ্ঠিত মুখে এসে দাঁড়ায়।
অতনু উদাত্ত স্বরে বলে, এই যে গায়িকা এসো এসো, বাড়ির আবহাওয়াটা একটু ভাল কর দিকি।
হ্যাঁ, যত পারে সপ্রতিভ হবে সে, তাছাড়া আর উপায় নেই।
বৌ গায়, এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে তা কে জানে!
এমন কিছু ওস্তাদ নয়, তবু গলাটি মিষ্টি, ধরনটি নরম, সত্যিই যেন বাড়ির উৎকট আবহাওয়াটার উপর একটা স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে যায়।…গানের পর গান চলে। পাকা গাইয়ে নয় যে, একটার বেশি দুটোর অনুরোধ এলেই গলাভাঙার অজুহাত দেখাবে। দেখা যায় ডাক্তার অতনুর বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে, অমিতা শান্ত মুখে বসে আছে হারমোনিয়ামের কাছে।
কেউ বসে থাকে, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে, কেউ একটু দাঁড়িয়ে চলে যায়। গান শুনে তো আর পেট ভরবে না কারুর।
জগতের আদিমতম সত্য পেট, শাশ্বত সত্য ক্ষুধা। এরা কোনদিন কখনো বিভোর হয়ে যেতে দেবে না মানুষকে।
শিল্পে নয়, সঙ্গীতে নয়, সাহিত্যে নয়, ঈশ্বরোপলব্ধির অনির্বচনীয়তায় নয়, মহৎ জীবনের আহ্বানে নয়, রোগে শোকে দুঃখে হতাশায় নয়। কোন কিছুতেই বিভোর হয়ে থাকা চলবে না। অদৃশ্য এক রজু মনের পিছু থেকে টানতে থাকবে–খাওয়া দাওয়া হয়নি, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে তো?
খাবার দেরি হয়ে যাবে, খাওয়ার সময় উৎরে গেছে, না হলে আর একটু বসতাম।
.
চলে গেল প্রায় সবাই।
চলে গেলেন বড়পিসিমা আশ্রমে, গুরু জয়ন্তীর সন্ধ্যেআরতি দেখতে। জয়াবতী উঠে গেলেন গতকালের মিষ্টি কোথাও জমা হয়ে পড়ে আছে কি না দেখতে! যে গরম, আজ বাদ কালই তো ফেলা! তাছাড়া কোন ফাঁকে কোথায় পাচার হয়ে যাবে।
আপাতত মেয়ে আগলানোর থেকে মিষ্টি আগলানো বেশি জরুরী মনে হল জয়াবতীর।
আর তাকিয়ে দেখলেন এই গানের মূছনার মধ্যে কখন শুয়ে পড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। কটা গান শুনেছিল? কখন ঘুমিয়ে পড়ল? অত গভীর ঘুম এখুনি কি ভাঙবে?
.
কিন্তু ভাঙল।
যখন গান সেরে বৌ মিষ্টি হেসে উঠে গেল। আর দীপক উঠে গেল বাজনাটা রেখে আসার ছুতোয়। ওর নববিবাহিতারপশ্চাদ্ধাবনের ভঙ্গী দেখে অতনু একটু হাসল। নতুন বর কনে আর প্রেমিকা প্রেমিকা কত গল্পই না বানায়, কত ছুতোই না আবিষ্কার করে!
কিন্তু শুধুই কি নতুনেরা?
৩. ঘরে কেউ নেই
ঘরে কেউ নেই।
শুধু শিথিল শয়ানে রাজকন্যা ঘুমে অচেতন। ঘরে কেউ ঢাক পেটালেও এ ঘুম ভাঙবে এমন আশঙ্কা নেই। তবু ঘরের মাঝখানে মিনিট দুই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল অতনু। তারপর গলা ঝেড়ে যেন দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিষ্কম্প গলায় বলল, ভোরের প্লেনে চলে যাচ্ছি। গিয়ে যেন শুনি না একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
বলা বাহুল্য এটুকুতে নিদ্রিতার নিদ্রাভঙ্গ হয় না।
অতনু আবার বলে, এবার বাড়ি যাচ্ছি, ভোরবেলা বেরুব। আর দেখা করে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই শেষ। হয়তো চিরদিনের মতই।