সে সময়ের যথার্থ সদ্ব্যবহার করেছে অমিতা, এই দেখেই ঘরে পরে সবাই ধন্যি ধন্যি করে তাকে।
তা কোন কাজটাই বা অমিতার ধন্যি ধন্যি করবার মত নয়? এই যে বিয়ের জন্যে অমিতা আজ দুমাস থেকে সিল্ক সাটিন লেস চিকন জরি পুঁতি আর রেশম চুমকি নিয়ে মাথা বিকোল, চোখ খারাপ করে ফেলল, সেগুলো কি কলের কাজকে হার মানায় নি? দরজিকে লজ্জা দেয় নি?
তারপর এই তিনচারদিন?
তাঁতির মাকুর মত টানা-পোড়েন করছে না অমিতা? নান্দীমুখের ঘরে কাঁচকলা কম পড়েছে কিনা, আর কাটলেটের কিমাটা কম থোড়া হল কিনা, এ তদারক কে করছে, অমিতা ছাড়া?
.
যজ্ঞির বিকেলে সংসারের তদারকিতে একটু ছুটি মিলেছিল। খাওয়া-দাওয়ার সমগ্র ব্যাপারটা বৃহৎ কর্মে গিয়ে ঠেকেছে, তাই কনে সাজানোর কাছে এসে একটু বসেছিল অমিতা।
সাজাবার সাধ অমিতার নিজেরই ছিল, কত আদরের দীপকের ভালবাসার বিয়ের বৌ। দেখতেও মোটামুটি ভালই। অমিতার হাতে সাজানোর ভার পড়লে সুন্দরীতে গিয়ে পৌঁছতে পারত, মনের মধ্যে এমনি একটা অহঙ্কারও ছিল বোধকরি, কিন্তু বাদ সাধল মহাশ্বেতা।
সে মুখটা করুণ করুণ করে বলল, তুই সাজাবি? তা বেশি ইচ্ছে হয় তো সাজা, তুই তো সর্বদাই দীপুর হিতকামনা করিস, করবি, তোর দ্বারা কি আর অমঙ্গল হবে?
অমিতা হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, অমঙ্গল হবে বুঝি? তবে থাক। একটু চুপ করে আবার বলল, আচ্ছা মহাদি, এ যুগেও ওসব অমঙ্গল-টমঙ্গল হয়?
মহাশ্বেতা গালে হাত দিয়ে বলল, শোন কথা! অমঙ্গলের আবার এ যুগ সে যুগ কি রে! যুগ পালটেছে বলে কি আর সাপে কামড়ালে বিষ লাগে না?
মোক্ষম যুক্তি! চুপ করে গেল অমিতা।
মহাশ্বেতা স্নেহময়ী, মহাশ্বেতার হৃদয় নরম, তাই সে ওর পিঠে হাত রেখে আদরের সুরে বলল, সাজাস! কাল থেকে যত পারিস সাজাস বৌকে, হাতের সুতোটা গলার মোনামুনিটা খোলা হোক, কাজললতাখানা হাত থেকে নামুক।
অমিতা আস্তে পিঠটা ওর হাতের ছোঁওয়া থেকে সরিয়ে নিল।
এই তো! শেষ খবর তো এই!
এই পর্যন্ত সবাই দেখেছে অমিতাকে, সহজ স্বাভাবিক। তারপর আর কই, কে তাকে দেখেছে? এত হট্টগোলে কে বা কাকে দেখে?
দেখেছিল, স্বয়ং বিয়ের বরই দেখেছিল। অমিতা তখন কনে সাজানোর পরবর্তী ব্যাপার মিটোচ্ছে। যারা সাজিয়েছিল তারা কনের চারখানা বেনারসী, যাবতীয় গহনা, এক সুটকেশ প্রসাধন সামগ্রী আর ডজন দুই সেফটিপিন, এক পাতা আলপিন, গোছ গোছ ফিতে কাটা ক্লিপ নিয়ে ছড়িয়ে বসেছিল। সাজাবার পর অমিতাকে সে সব তোলবার ভার দিয়ে হুড়োহুড়ি করে চলে গেছে আসরে, কনের সঙ্গে।
পাটখোলা বেনারসীগুলো খাটের ওপর স্তূপাকার হয়ে পড়েছিল, অমিতা পাট করে তুলছিল একে একে, এই সময় দীপক এসে দাঁড়াল, কিরে ছোড়দি, খুব খাটছিস?
অমিতা হাসল।
দীপকের মন কানায় কানায় উথলোচ্ছে, কথার সুখেই কথা কয়, কী রে বাবা কত শাড়ি।
অমিতা আর একবার হাসল।
এই ছোড়দি, জানিস অতনুদা এসেছেন!
অমিতার হাত থেকে পাট করা শাড়িখানা খস করে খসে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
দীপক অবশ্য সেদিকে তাকায় নি, সে সোৎসাহে বলে, এই তো কালই শুভেচ্ছা বাণীর টেলিগ্রাম এসেছে, আজ এসে হাজির। আমি তো অবাক! বললাম, এটা কি হল? হাসতে লাগলেন, বললেন, টেলিগ্রামটা করেই মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল, বেরিয়ে পড়লাম। বললেন, তোর আবার বিয়ে! ভেবেছি আর হাসি পেয়েছে। আমাকে বরাবরই খুব ভালবাসেন
অমিতা ছড়িয়ে পড়া শাড়িখানা আবার তুলে নিয়ে পরিপাটি ভাঁজ করতে লাগল।
রংটা খুব কালো হয়ে গেছে, দেখো চট করে চিনতেই পারবে না। বললেন, ম্যাড্রাসে। থাকতে হলে সকলেরই সোনার বরণ কালি হয়ে যায়। কথাবার্তা ঠিক সেই রকমই আছে।
এবার অমিতা কথা বলে।
কয়েক বছরে মানুষ একেবারে বদলে যায় এই বুঝি ধারণা তোর?
দীপক তাড়াতাড়ি বলে, তা নয়। মানে, মস্তবড় অফিসার-টফিসার হয়ে গেছেন।
অফিসার তো আজকাল গড়াগড়ি যাচ্ছে। বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া সেফটিপিনগুলো গুটোতে বসল অমিতা।
দীপক অবশ্য ঠিক এটা ভাবে নি।
বছর আষ্টেকের অদর্শন হলেও ওর ধারণা ছিল ছোড়দির প্রতি অতনুদার এবং অতনুদার প্রতি ছোড়দির বিশেষ একটু যে আকর্ষণ ছিল, সেটা এখনও আছে কোথাও, তাই অতনু আসার খবরটা ছোড়দিকেই আগে দিতে এসেছিল। কিন্তু অমিতার কাছ থেকে কোন সাড়া এল না। না চমকেই উঠল, না বা মুখের রংটাই একটু বদলাল! কথা একটা কইল, তাও আগ্রহ-শূন্য রসশূন্য। তবে আর কি করা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল দীপকের। ভাবল ছোড়দির মনটা একেবারে মরে গেছে। ভাবল– যাবে না? সমস্ত দিন ওই হলুদ পাঁচফোড়ন নিয়ে পড়ে থাকলে মন মরে যাবে না?
তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে? জিগ্যেস করল অমিতা।
দীপক এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনটা ধরতে পারল না। না পারবারই কথা। বিয়ের ঠিক পরমুহূর্ত থেকে গোটাকয়েক দিন কোন্ ছেলেটাই বা একটু বুদু বনে না যায়? আর দীপক তো চিরকেলে বুন্ধু। এই প্রেমে পড়ে বসাই তো তার প্রমাণ। বুদ্ধ না হলে আর কে কবে প্রেমে পড়ে?
বুন্ধুর মতই উত্তর দিল সে, না রে ছোড়দি, সেই থেকে তো তাই ভাবছি। ফোন করব একটা?
অমিতা হেসে বলল অত করতে হবে না, আসবে ঠিকই। না আসা পর্যন্ত তোর বৌয়ের মনটা মনমরা হয়ে থাকবে এই আর কি।
বাঃ তা কেন? দীপক শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে, এখন থেকে তো এ বাড়িটাকেই নিজেদের বাড়ি বলে মনে করতে হবে?