কোথায়? বিজয় মাথা নাড়ে।
ওমা বলিস কি? তেমনিই চলছে? ডাক্তার আসে নি?
এসেছিল।
কি বলল?
বলল আর কি, বলল হিস্টিরিয়া।
বড়দি মাথা নেড়ে বলেন, কিন্তু আজকাল তো বাপু আর হিস্টিরিয়া হতে দেখি না! হ্যাঁ সে ছিল বটে আগে, ঘোমটা দেওয়া বৌ ঝি তোলপাড় কাণ্ড করত, লোকলজ্জার মাথায় লাঠি বসাতে। কিন্তু একালে–।
হ্যাঁ একালে মেয়েদের ঘোমটা উড়ে যাওয়া, আর ঘরের খাঁচা ভেঙে বাইরে বেরোনোর প্রথা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়াটা দেশ থেকে বিদায় হয়েছে বটে, নন্দা খুব অমায়িক গলায় বলে, তবু সব জিনিসের মতই কোথাও না কোথাও একটু জের তো থাকবেই।
বড়দি বিস্ময় দৃষ্টি মেলে বলেন, ঘোমটার সঙ্গে, রাস্তায় বেরোনোর সঙ্গে রোগ-অসুখের কী হোটবৌ?
ওর কথা ছেড়ে দাও বড়দি, বলে বিজয় বড়দির অলক্ষ্যে বৌকে একটি শাসনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বড়দির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায়।
.
বড়দি অবশ্য হুড়মুড়িয়ে একেবারে কালকের সেই ঘরেই ঢোকেন, দেখেন অমিতা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আঙুলে আঁচল জড়াচ্ছে।
বড়দির পরনে চওড়া লালপাড় গরদ শাড়ি, কপালে মস্ত সিঁদুরটিপ, সিঁথেয় চওড়া করে সিঁদুর ঢালা।
তিনি অমি, কেমন আছিস মা? বলে ঘরে ঢুকতেই অমিতা তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলে, ওমা, কাদের কনেবৌটি গো? বাঃ, খাসা মুখখানি তো!
বড়পিসিমা সভয়ে পিছু হঠে বলেন, ও কী কথা অমি? সত্যিই কি তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলি?
অমিতা আরও কাছে এসে হেসে উঠে বলে, ও কনে, তোমার হাতে সুতো কই? কাজললতা কই?
বড়পিসিমা চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ও বড়বৌ, মেয়ে এসব কি বলে গো? একেবারে বেহেড পাগল হয়ে গেল?
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় অমিতার সবছোট ভাইটা, দাঁড়ায় সেজগিন্নীর মস্ত বড় মেয়েটা।
সে বিরক্তি মাখানো মুখে চাপা গলায় বলে, আপনাদের এই সব কাণ্ডর কোনও মানে . পাওয়া যায় না পিসিমা! মেজদির সামনে এসব কথা বলার দরকার কি?
পিসিমা অবাক বিস্ময়ে বলেন, ওমা, তুই যে আমায় অবাক করলি সবিতা, সামনে পিছনে আবার কি? মন্দ কথা কিছু বলেছি?
না খুব ভাল কথা! চলুন ও ঘরে গিয়ে বসি গে।
তুই থাম। বলে বড় পিসিমা আবার এগিয়ে যান, কিছু খেয়েছিস রে অমি?
হ্যাঁ! অমিতা অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে বলে, কত কী! হাতী ঘোড়া, সাপ ব্যাং মাছ—
ছি ছি, ও কথা বলতে নেই মা! চুপ করো চুপ করো।
সবিতা আবার বলে ওঠে, পিসিমা! চলুন না ও ঘরে।
এ তো আচ্ছা জ্বালা করল! পিসিমা বলেন, মেয়েটাকে দেখব বলে আমি গুরুভগ্নীদের অনুবোধ এড়িয়ে ছুটে এলাম!
সবিতা বিব্রতভাবে বলে, তা আপনি ভাতটাত খাবেন তো?
শোন কথা, আশ্রম থেকে আমি পেসাদ না খেয়ে এসেছি? দুবেলা পেসাদের নেমন্তন্ন। …অমি মা, আমার সঙ্গে যাবি আশ্রমে? সন্ধ্যেআরতি দেখিয়ে আনব।
হঠাৎ অমিতা সবাইকে চমকে দিয়ে চীৎকার করে উঠল, ওরে বাবা রে, আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দিতে চাইছে! তারপর সুরু হল কান্না।
আবার অমিতা গলা ভাঙল, চোখ ফুলিয়ে ঢোল করল। তাকে নাকি বেঁধে নিয়ে হাঁড়িকাঠে চড়ানো হচ্ছে।
ডাক্তারকে আর একবার কল দেওয়া হোক। বললেন সেজকর্তা, এভাবে তো বাড়তে দেওয়া যায় না।
জগন্ময় বসে পড়ে বললেন, যা পারো তোমরা কর ভাই!
জয়াবতী সারাদিনের পর অবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এই করুণ আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে ছুটে এলেন। হাঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলেন, উপোস করে শরীরের ভেতরটা তোর জ্বলে খাক হয়ে গেল অমু, একটু কিছু খা, শরীর ঠাণ্ডা হবে।
অমিতা কেঁদে উঠে বলল, এই হাঁড়িকাঠটা থেকে আমায় একটু বার করে দাও না গো! · এক্ষুনি আমায় কেটে শেষ করে দেবে।
দীপুকে ডেকে আনবো অমি? তোমার সেই ছোট ভাইটি? টোপর পরলো বিয়ে হল।
না না, ও ভাল ছেলে লক্ষ্মী ছেলে, ও এখন শুধু সিনেমা দেখবে।
তবে নতুন বৌকে ডাকি?
না না! অমিতা ভাঙা গলায় বলে, ও আসবে না, ও শুধু নেমন্তন্ন খাবে। আমি মরে যাব, আমাকে কেটে ফেলবে।
তা পাগলে তো অর্থহীন অসংলগ্ন কথাই কয়।
জয়াবতীও বোধকরি মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হয়ে গেছেন, লোকলজ্জা ভুলেছেন, নইলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলে বসেন, অতনুকে ডাকব অমু?
সঙ্গে সঙ্গে অনুচ্চারিত একটা ছিছিক্কারে ঘরের বাতাস ধাক্কা খেয়ে ওঠে। বিজয় জয়াবতীর দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আশ্বস্ত করে অমিতা চেঁচিয়ে ওঠে, ওকে কেন? ও পরের বাড়ির ছেলে। তোমার লজ্জা করে না?
.
ও পাশের ঘরে পরের বাড়ির ছেলে আর ঘরের ছেলেটা দুজনে বসে ছিল মুখোমুখি। অতনুর হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট শুধু হাওয়ায় পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হচ্ছে।
এতক্ষণে সেটাকে ঠুকে ছাই ঝেড়ে অতনু বলে, আমাদের দেশের মহিলাদের কবে যে সত্যিকার বুদ্ধিসুদ্ধি হবে! পৃথিবীতে কত আশ্চর্য এলো, কিন্তু সপ্তম আশ্চর্য দেখার বাসনার আর এঁদের নিবৃত্তি হল না। ক্রমাগত ওঘরে উঁকি দেবার দরকারটা কী, তাই বল দিকি? ওর চিকিৎসাই হচ্ছে একা চুপচাপ শান্তিতে থাকতে দেওয়া, তা নয় সবাই যেন জু-গার্ডেনের জু দেখতে এসেছে। কৌতূহলের শেষ নেই, উঁকিমারার শেষ নেই। বোঝে না এতে আরও ক্ষেপে যাবে।
আপনি গিয়ে বারণ করে আসুন না।
আমি?
দীপক বীরত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে, কেন নয়? আপনি ডাক্তার, আপনার রাইট আছে রোগীর সম্পর্কে ব্যবস্থা দেবার।