ওমা! আহা-আহা মরে যাই, চল চল। সিঁড়ির দিকে দৌড় দেয় অমিতা।
ও অতনু, কী হবে? ও যে পড়ে যাবে! জয়াবতীও দৌড়ন। দৌড়তে দৌড়তে ডুকরে ওঠেন।
পড়বে না!
অতনু চাপা দৃঢ় স্বরে বলে, আপনি একটু কম অধীর হোন, ওসব মাথায় ঢুকিয়ে দেবেন না। চলুন, সত্যিই বসে পড়ে বলুন আপনাকে খেতে দিতে।
কী যে বল বাবা!
জয়াবতী বলেন, আর আমার সে কপাল হয়েছে! নইলে সেই মেয়ে এই হয়! পূজো করে উঠে এসে দাঁড়াতেই মুখের সামনে চায়ের গেলাস, জলখাবারের রেকাবী ধরে দিয়েছে। ভাত খেতে একটু বেলা হলে, কোথা থেকে জোগাড় করে এনে হাতে তুলে দিয়েছে ঘোলের শরবৎ, মিছরীর পানা। ও যেন মা, আর আমি মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম অতনু!
ততক্ষণে পাগলিনী তরতরিয়ে নেমে গেছে।
অতনু আর জয়াবতী আস্তে আস্তে নামছেন।
অতনু একবার জয়াবতীর মুখের দিকে তাকায়। বোধকরি বিরক্তি গোপন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাই গম্ভীর বিরক্ত কণ্ঠে বলে, বেশ করেছিলেন। এখন যান সেই ভাবেই খান গে। সহজ ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন। অবিরত আক্ষেপ করবেন না ওর সামনে। দেখুনগে হয়তো খাবার গুছিয়ে বসে আছে ইতিমধ্যে।
.
আশ্চর্যের কথা, অতনুর কথাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
হয়তো অতনু ডাক্তার বলেই। ডাক্তার নইলে রোগীর মনস্তত্ত্ব কে বুঝবে?
নীচে নেমে এঘর ওঘর করে জয়াবতী দেখেন তার শোবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অমিতা, জয়াবতীকে দেখে হাতছানি দিল মিটিমিটি হেসে।
কাছে গিয়ে দেখেন কোথা থেকে না কোথা থেকে এক থালা মিষ্টি জোগাড় করে বসিয়ে রেখেছে ঘরের মাঝখানে, জলের কুঁজোটাই নামিয়ে রেখে দিয়েছে তার পাশে!
জয়াবতীকে দেখেই চোখ টিপে ব্যস্ত আর চুপিচুপি স্বরে বলে, খেয়ে ফেল খেয়ে ফেল, নইলে কেড়ে নেবে।
অমি, তুই আবার আমায় হাতে করে খেতে দিলি? জয়াবতী ঊ্যাক করে কেঁদে ফেলেন। চোখ মুছে বসে পড়ে বলেন, এত কি আমি খেতে পারি মা? আয় না, আমার সঙ্গে তুইও খা।
ওমা, কী বোকা! আমায় বলছে খেতে। ছুটে বেরিয়ে যায় পাগলী।
.
দেখলে? দেখলে ছোট বৌ?
সেজগিন্নী বলে ওঠেন, কাল থেকে তো মেয়ে স্বর্গ মর্ত্য এক করছে, এখন দেখলে? ভাড়ার উটকে টেনেহিঁচড়ে মিষ্টির কাড়ি নিয়ে কি রকম ছুট দিল? সে দিকে তো জ্ঞান টনটনে যে, মায়ের পূজো সারা হয়ে গেছে, জল খেতে দিতে হবে।
নন্দা গম্ভীর ভাবে বলে, ভালই তো, মাথার সাড় ফিরছে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সেজগিন্নী উঠে যান, তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে সেজকর্তাকে বলেন, সেয়ানা পাগল বোঁচকা আগল!
সেজকর্তা গম্ভীর মুখে বলেন, কথাটা বড় পচা পুরনো।
যা খাঁটি তাই পুরনো! এই শুনলাম মেয়ে নাকি গলদঘর্ম হয়ে রোদ্দুরে ছাতে বেড়াচ্ছে, মা টেনে আনতে যাচ্ছেন। আবার এক্ষুনি মার জন্যে জলখাবারের থালা সাজাতে বসল।
কী করতে বসল? সেজকর্তা তীব্র প্রশ্ন করেন। ওই তো বললাম, খাবারের থালা সাজাতে। মস্ত একখানা থালা নিয়ে এত সন্দেশ, এত দরবেশ, এত পান্তুয়া, এত
তা ওটাও তো খেয়ালের ঝোঁক।
ওই আনন্দেই থাক। বলে সেজগিন্নী মুখ বাঁকান। আর পরক্ষণেই বলেন, আর তোমার ভাজের পায়েও কোটি কোটি প্রণাম। অতনু অতনু করে যা আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন?
যাক বড়গিন্নীর বরাত ভাল! যে দুর্লভ প্রণাম ভাগ্যে একটা জোটে না সেই প্রণাম কোটি কোটি।
এখন হাসছ পরে বুঝবে। বলে রোষভরে চলে যান সেজগিন্নী।
নীচের তলায় তখন বিজয় ব্যস্ত হয়ে গত কালকের ডেকরেটারের বিল মেটাচ্ছিল, কারণ বিয়ের উৎসব বাবদ কর্তৃত্বটা তারই অধিকারে এসেছিল।
পাওনাদাররা চলে যেতেই বিজয় স্ত্রীর কাছাকাছি এসে বলে, অতনু রয়েছে না?
হুঁ।
কোথায়? কোথায় রয়েছে?
কি জানি! ওপরের কোনও ঘরে। নন্দা স্বভাবসিদ্ধ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে।
বিজয় বিরক্ত স্বরে বলে, কোনও ঘরে বলে গা ভাসিয়ে দিলে যে? নিশ্চয় ওই ঘরেই।
নন্দা অমায়িক মুখে বলে, সেটাই স্বাভাবিক, আর সেটাই উচিত।
উচিত।
নয় কেন, ডাক্তার বলে গেছে, ও যা চাইবে তা দিতে।
ডাক্তারের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না ওর চাহিদা কি, তাই বলেছে। বাস্তবিক এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার হল?
ব্যাপারকে অবিরত ঢাকা দিয়ে দিয়ে সুশ্ৰী করে রাখতে গেলেই, একদিন সে বিশ্রী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে বসে। তোমাদের উচিত ছিল ওর আবার বিয়ে দেওয়া। আর ওই অতনুর সঙ্গেই দেওয়া। আশ্চর্য, কারুর যে কেন মাথায় আসে নি? হিস্ট্রিটা যখন সকলেরই জানা ছিল।
তোমারও ছিল!
আমি কি জন্যে বলতে যাব? আমি কে? সংসারে আমার কথা দাঁড়াচ্ছে কোথায়?
বিজয় গম্ভীরভাবে বলে, কথাকে দাঁড় করাতে হয়। সেটা নিজের ক্যাপাসিটি। তুমি এত বেশি–এই সেরেছে, আবার বড়দি আসছেন যে!
নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, বড়দি তো ছিলেনই। শুধু সকালে আশ্রমে গিয়েছিলেন, গুরুজয়ন্তী উৎসবে। আজই দিনটা পড়েছে বলে কত আক্ষেপ করে গেলেন।
তা না হয় গেলেন। কিন্তু গুরুজয়ন্তী কি?
কেন, গুরুর জন্মোৎসব! আসছে বছর সুবর্ণ জয়ন্তী হবে বলে এখন থেকেই তোড়জোড় চলছে।
বিজয় বলতে যাচ্ছিল, একটা মহারাজ টহারাজ বনে গেলে মন্দ হত না। কিন্তু বলা হল না, বড়দি এসে গেছেন।
বড়দি অর্থাৎ অমিতার বড়পিসিমা, মহাশ্বেতার মা। মহাশ্বেতার মতই করুণাময়ী।
কাছে এসেই করুণ কণ্ঠে বলেন, হ্যারে, মেয়েটার মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে? নাওয়া খাওয়া করেছে?