লোকে তো তা বলছে না।
সবাই তো বলছে এত লক্ষ্মী মেয়ের এ কেমন ধারা! এত শান্ত মেয়ের এ কী ব্যবহার! বলছে, এ সংসার মাথায় করে রেখেছিল অমিতা। বলছে, অমিতার বুদ্ধি বিবেচনার তুলনা হয় না, তুলনা হয় না ভব্যতা আর সংযমের। বিধবা হয়ে পর্যন্ত অমিতা নাকি চুলে কোনদিন গন্ধতেল দেয় নি, গায়ে মাখে নি সৌখিন সাবান। খাওয়া দাওয়ায় এত কৃচ্ছসাধন নাকি এ যুগের বিধবাদের মধ্যে দুর্লভ। আর সেই যে একদিন দামী আর সৌখিন শাড়িটা অঙ্গ থেকে বিসর্জন দিয়েছিল, তদবধি ওই ইঞ্চিপাড় হাফ শাড়ি ছাড়া দুইঞ্চি পাড় পুরো শাড়ি একখানা পরে নি কোনদিন।
এমন মেয়ে, এমন স্থিতধী আর আত্মস্থ মেয়ে, সে কি করে এমনতর কাণ্ড করছে! ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না অতনু। ভেবে পাচ্ছে না নিজের ভূমিকা কতটুকু বিস্তৃত করবে? বকবে? ধমকাবে? ডাক্তারের মত কঠিন হবে?
জানলা দিয়ে দুপুরের রোদের প্রচণ্ড হলকা আসছে, আসছে ধূলো, অতনুর খেয়াল নেই। হঠাৎ পিছন থেকে ডাক পড়ল, এই দেখসে বাবা, আবার এক কাণ্ড!
জয়াবতী ডাকছেন আর্তচীৎকারে।
কী?
কোন্ ফাঁকে উঠে গিয়ে এই দুর্দান্ত রোদ্দুরে ছাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে কী? ব্যস্ত হয়ে এগোয় অতনু।
আর সে কী! জয়াবতী কপালে করাঘাত করে বলেন, আমার এই কপালটা একবার তোমাদের ওই ডাক্তারী ছুরি দিয়ে চিরে দেখাতে পারো অতনু? দেখি তার ভেতর কী আছে?
পরে দেখবেন। এখন আসুন। বলে অতনু ছাতে ছোটে।
হ্যাঁ ছুটবে।
সে ডাক্তার, তার অধিকার আছে। তার কর্তব্য রোগীর ভাল মন্দ দেখা।
জয়াবতী ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপান, আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, পূজো করে উঠে ঠাকুরের চরণামৃত একটু মাথায় বুলিয়ে দেবো বলে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে নেই। সর্বশরীর তো হিম হয়ে গেল আমার। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিলাম, বলি সর্বনাশের চরম করে বুঝি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কী গুরুর রক্ষে, নতুন চাকরটা এসে বললে, দিদিমণি ছাতে উঠেছে। ছোঁড়া কালকের দরুন জগ বালতি সব নামাতে গিয়েছিল–
কিন্তু জয়াবতীর এত কথা শুনছে কে? তার অর্ধেক সিঁড়ি ওঠার আগেই তো অতনু ছাতের জমিতে।
প্রকাণ্ড ছাত, একেবারে তারও সীমান্তে দাঁড়িয়ে রুক্ষ এলোকেশী।
এই রোদে ছাতে এসেছ কেন?
দ্রুত পায়ে সামনে গিয়ে প্রবল সুরে প্রশ্ন করে অতনু, তোমার মা ভেবে অস্থির হচ্ছেন।
হঠাৎ স্রেফ পাগলিনীর হাসি হেসে ওঠে অমিতা, আমার মা আমার জন্যে ভেবে অস্থির হচ্ছেন? হি হি হি! খুব একটা মজার কথা শোনালে বটে ডাক্তার!
মার জন্যে তোমার কষ্ট হয় না? রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করে অতনু।
কষ্ট? হি হি হি! মার জন্যে কষ্ট! তুমি তো বেশ দয়ালু!
এই সময় ধড়ফড় করতে করতে কোনমতে উঠে এসেছেন জয়াবতী। বলেন, এই রোদে ছাতে কেন মা অমি?
অমিতা এলোচুলের গোছা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলে, বোদ পোহাচ্ছি।
এই কি রোদ পোহানোর সময় মা? চল নীচে চল। দেখছ না অতনুদা তোমায় ডাকতে এসেছে! না গেলে বকবে।
আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকেন জয়াবতী।
পাগলিনী অপরূপ এক ঠোঁটের ভঙ্গী করে বলে ওঠে, ইয়ে বিল্লি হিল্পী দিল্লী। বকবে! ও আমায় বকবে! ভারী সাহস ওর! যাব না আমি নীচে। দেখি তো কী করে!
অমিতা, পাগলামী কোর না। নীচে চল। এটা ছাতে বেড়াবার সময় নয়। নীচে না যাবে তো জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। অতনু বলে।
আহা সত্যি! হেসে গড়িয়ে পড়ে অমিতা, কর না একটু জোর! দেখি তুমি কেমন পালোয়ান।
অতনু কালা, অতনু নির্বিকার!
অতনু ডাক্তার। অতএব ধমক দিতে পারে অতনু। বলতে পারে, হচ্ছে কি? এ রকম যা ইচ্ছে করলে ডাক্তারবাবু এসে ইলেকট্রিক শক লাগিয়ে জব্দ করে দেবেন তা জানো?
অমিতা মুখ বাঁকিয়ে বলে, ডাক্তার হয়ে আবার ডাক্তারের ভয় দেখাচ্ছে। নিজের নেই কানাকড়া ক্ষমতা! আমি যাবো না। আমি রাস্তা দেখব–আলসের ধারে গিয়ে ঝোঁকে অমিতা।
হাঁ হাঁ করে ছুটে যান জয়াবতী, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলেন, অতনু, বুঝি কী সর্বনাশই করে!
আঃ। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অমিতা।
অতনু জয়াবতীকে ইশারায় নিষেধ করে ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে। নীচু গলায় বলে, ওসব কথা মাথায় ঢোকাবেন না। তারপর গলার স্বর উঁচু করে বলে, যাবে তো চলো, নইলে আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি রোদে ঝলসাও বসে বসে।
সত্যিই ঝলসাচ্ছে অমিতা। রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে, শুকনো মুখ রোদের দাহে তামাটে হয়ে উঠেছে, ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। সেই ঝলসানো মুখে হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় কথা কয়ে ওঠে অমিতা, ঝলসাবোই তো। ঝলসে ঝলসেই তো মরব। আমায় তো কেউ ভালবাসে না? ছাতের আলসেয় ফের ঝেকে অমিতা।
জয়াবতী আবার দুহাত দিয়ে আগলে ধরতে যান, বাসে মা, সবাই ভালবাসে তোমায়। তুমি আমাদের চোখের মণি, বুকের হার, তোমায় ভালবাসবে না? এই দেখ এতখানি বেলা, এখনো জল মুখে দিই নি, তোর জন্যে ঘুরে মরছি।
মার হাতটা আবার ঠেলে দেয় অমিতা। কান্না ছেড়ে হাসে। মরছ কেন? যাও না, খাওগে। এদের বিয়ে বাড়িতে কত মিষ্টি কত খাবার! আহা তোমায় বুঝি দেয় নি কেউ?
অতনু গম্ভীরভাবে বলে, কে দেবে? কেউ দেখে ওঁর খাওয়া? তুমি এই রকম আহ্লাদ করে বেড়াবে, আর উনি উপোস করে বেড়াবেন? যাও না, দাও না গিয়ে ভাল করে খেতে। কাল থেকে খান নি।