এখান থেকেই একটা টুল সংগ্রহ করে ও ঘরে জানলাটার কাছে টেনে নিয়ে বসল অতনু। বসল নিজেকে খুঁজতে।
অতনু কেন এখানে রইল? জয়াবতীর অনুরোধে? নিরুপায়তায়?
ওটুকু অনুবোধ এড়াবার ক্ষমতা তার ছিল না? নম্র দৃঢ়তায় যদি বুঝিয়ে দিতে পারত আজই তাকে চলে যেতে হবে, বাড়িতে না খেলে দাদা বৌদি মনঃক্ষুণ্ণ হবেন, সত্যিই কি আর বুঝতেন না জয়াবতী?
নিরুপায়তা নয়, লোভের হাতে আত্মসমর্পণ করে বসেছে অতনু। হ্যাঁ, যে লোভের আক্রমণে অনেক অনেক মাইল অতিক্রম করে ছুটে এসেছে তুচ্ছ একটা উপলক্ষকে আঁকড়ে ধরে।
আজও এই তুচ্ছ উপলক্ষটা আঁকড়ে এ বাড়িতে বসে রইল অতনু। এখানে বসে থাকবে, এদের সঙ্গে ঘরের ছেলের ভূমিকা নিয়ে সহজভাবে খাবে দাবে, হয়তো বা গা গড়িয়ে বিশ্রামও করবে, আর ওই এক বেপরোয়া পাগলিনী চীৎকার করে উঠলে তার কাছে গিয়ে তাকে বকবে, সান্ত্বনা দেবে, ওষুধ খাওয়াবার জন্যে খোসামোদ করবে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি!
আর এ পরিস্থিতিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে অতনু।
আচ্ছা, সহজ স্বাভাবিক ধারার বদলে এরকম একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে কি অতনু খুশি হয়েছে? কৃতার্থ হয়েছে? ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে?
এটা তো সত্যি, এহেন একটা এলোমেলো কাণ্ড না হলে হয়তো অমিতার সঙ্গে দেখাই হত না। হয়তো বা দূরে থেকে সকলের মাঝখান থেকে একবার দেখা হত, চোখাচোখি করবারও সাহস হত না। বিধবা অমিতাকে কে অনুমোদন করত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করতে? কেউ করত না। দেশ এখনো এত উদার হয় নি।
হয়তো এই জগন্ময়ই অতনুকে বাইরের ঘর থেকে বিদায় দিতেন অন্দরের দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে। হয়তো এই জয়াবতীই স্নেহে বিগলিতভাব বজায় রেখেও ঠায় বসে থেকে পাহারা দিতেন অতনুর চঞ্চল দৃষ্টিকে, আশাতুর হৃদয়কে।
আজ ওঁরা বিপদে পড়েছেন।
তাই জগন্ময় বলছেন, তুমি থাক বাবা। জয়াবতী বলছেন, তুমি যদি পারো একটু খাওয়াতে। সংসারের আরও সদস্যরা ওসব কিছু না বলুন, তেমন কিছু বলছেনও না।
আর অতনু পরমোল্লাসে এর সুযোগ নিচ্ছে।
নিজেকে খুঁজে খুঁজে এই আবিষ্কারই করে অতনু, এমন একটা অঘটনের মাঝখানে এসে পড়ে সে যতটা ব্যথিত হয়েছে, পুলকিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি।
বিধাতার আশীর্বাদে ভিতরটা কেউ দেখতে পায় না এই রক্ষে।
তবু সকালে একবারের জন্যে বাড়ি গিয়েই বৌদির প্রবল জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল।
ঢুকতে না ঢুকতেই বৌদি মহোৎসাহে এগিয়ে এলেন মুখ বিষণ্ণ করে।
ব্যাপার কি ঠাকুরপো? ওদের অমিতার নাকি হঠাৎ কী অদ্ভুত অনাসৃষ্টি অসুখ করেছে? ওমা, এই তো কাল সন্ধ্যাবেলা দিব্যি নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে, দেখলাম অমিতা কনে সাজানোর কাছে বসে আছে। কখন কী হল?
অতনুকে উত্তর দিতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল, কখন কি হল তা আর আমি কি করে জানব? লোকজন চলে যাবার পর গোলমাল শুনলাম দীপু বলল দেখতে
তা হ্যাঁ ঠাকুরপো, মানুষ এমন বিনা নোটিশে হঠাৎ পাগল হয়? ডাক্তার মানুষ তোমরাই জানো!
রোগ অসুখ যে হঠাৎ কি ভাবে হয় বা হতে পারে, সে কথা ডাক্তারের পক্ষেও বলা শক্ত। আমি অন্তত বলতে পারি না।
বৌদি মুখ করুণ করে বললেন, আহা দেখ দিকি কাণ্ড! তুমি সেই দূর দূরান্তর থেকে এলে একটু আমোদ আহ্লাদ করতে, আর এই ব্যাপার! যতই হোক ছেলেবেলার বন্ধু! দেখে তো মনটায় কষ্ট হচ্ছে।
অতনু গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, দেখে কষ্ট সকলেরই হচ্ছে। ছেলেবেলাকার বন্ধু না হলেও।
সে তো বটেই। তবে কি না– বলেই বৌদি হঠাৎ করুণ মুখটাকে হাসিতে উদ্ভাসিত করে বলে উঠলেন, অবিশ্যি এই গোলমালে বাল্যসখীকে একটু দেখতে পেলে। তা নইলে
আপনার দৃষ্টিটা খুব সুদূরপ্রসারী সন্দেহ নেই।
তা ভাই সত্যি ভিন্ন মিথ্যে বলি নি। তবে এও বলব, আজই তোমার চলে যাওয়া উচিত হয় না। বৌদি উদগত হাসি চেপে বলেন, শুনছি নাকি কাল থেকে কেবল তোমাকেই আঁকড়াচ্ছে, তোমার কাছে ভিন্ন খাচ্ছে না, কাজেই আর দুদিন না দেখে
দেখতে তো যান নি একবারও, এত কথা শুনলেন কার মারফৎ?
শোনো কথা! পাড়ার লোকের ঘরের খবর আবার কেউ কাউকে শুনিয়ে যেতে হয় নাকি? সে খবর বাতাসে ভাসে, বুঝলে?
বুঝলাম! বলে স্নানের উদ্যোগ করতে যাচ্ছিল অতনু, ঠিক সেই সময় আবার মহাশ্বেতার প্রেরিত চাকর ছুটে ডাকতে গিয়েছিল।
অতনু বোধকরি সবলে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়েই বলল, চল যাচ্ছি।
বৌদি বললেন, দেখলে তো?
কিন্তু শুধুই কি বৌদি? অতনু টের পাচ্ছে, আড়ালে আড়ালে সকলেই ওই কথা বলাবলি করছে–দেখলে তো? সত্যি এ আবার কেমন লোগ! মা নয়, বাপ ভাই নয়, একটা পরপুরুষের জন্যে আকুলতা অস্থিরতা!
কিন্তু কি করে টের পাচ্ছে অতনু? কেউ কি বলে গেছে ওকে? না বলে কে যায়? হয়তো বা অতনুর বৌদির কথাই ঠিক, বলতে কাউকে কিছু হয় না। যে কথা অনেকের মুখে আলোচিত হয়, সে কথার রেশ বাতাসে ভাসে।
অতনু কি তা হলে চলে যাবে? এই লোকলজ্জার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে? আর সেই চলে
যাওয়ার হতাশাতেই উন্মাদিনী স্তিমিত হয়ে যাবে, শান্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু চলে যাবার শক্তি অর্জন করবে অতনু কোন শক্তির জোরে?
আচ্ছা, অমিতার একি হল? এমন করছে কেন ও? অতনুর এই দীর্ঘদিনের অদর্শনের অবকাশে ও কি এইভাবে নিজেকে ধ্বংস করছে বসে বসে?