কিছু তো চাইছে না ডাক্তারবাবু জগন্ময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, শুধু কাঁদছে!
কাঁদছেন তো আপনি ডাক্তার মৃদু হাসেন, রোগীর সামনে আদৌ উতলা হবেন না, আর, ঘরে ভিড় করবেন না। এক-আধজন যাকে ও পছন্দ করে, তেমন কেউ কাছে থাকুন। তিনি খাওয়ান, ওষুধ দিন।
কি খাবে? কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেন জগন্ময়।
লিকুইড খাক না হয় আজ! খাওয়ায় বাধা কিছু নেই, যা খেতে চাইবে দেবেন। কথা হচ্ছে, কোন কিছুতেই বাধা দেবেন না, প্রতিবাদ করবেন না। কাকে কাছে পেতে চায়? মাকে? নাকি আপনাকে? আপনার যা অবস্থা দেখছি, আপনার না থাকাই ভাল, অবিচলিত থাকতে পারবেন না। সেরে যাবে, দুচার দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। এক্টা খারাপ, এই যা একটু
দেখছেন তো ডাক্তারবাবু, এই বয়সে বিধবা
হ্যাঁ সে তো দেখছিই। তবে অনুরোধ করছি এ ধরনের কথা আদৌ ওর সামনে বলবেন না। কেমন থাকে খবর দেবেন। আর ওই যা বললাম, এত লোক নয়, ভিড় সরান। শুধু মা
শুধু মা! ডাক্তার বলে গেছেন শুধু মা!
কিন্তু কে চায় মাকে?
অমিতা যে কেঁদে বালিশ ভাসাচ্ছে, না না, ও আমার মা নয়, ও মহাদির মা!
জয়াবতীও কাঁদতে শুরু করেন, আমি তোর মা নই অমি?
না, তুমি মহাদির মা! খাব না আমি তোমার হাতে, খাব না!
কবে কার হাতে খাবে? আর না খেয়ে কি করে বাঁচবে কাল থেকে উপোসী মানুষটা?
নতুন বৌয়ের হাতে খাবে? দীপকের হাতে? কাকাদের হাতে?
না না না, আমি খাব না।
দুধ নয়, চা নয়, ওষুধ নয়, কিছু খাবে না অমিতা।
মহাশ্বেতা টেপা মুখে বলে, কাল থেকে তো দেখছি অতনুর ওপর ঝোঁক করছে, তাকেই নয় ডাকো।
জয়াবতী একবার ভাগ্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিরস গলায় বলেন, সে পরের ছেলে, তার ওপর আর কত জুলুম করব? এতক্ষণ থেকে ডাক্তার আসা দেখে তবে বোধহয় বাছা নাইতে খেতে বাড়ি গেল।
আহা, খাওয়া তো এখানেও একমুঠো হতে পারত–মহাশ্বেতা স্নেহে গলে গিয়ে বলে-কাল তো কিছুই খায় নি। মাছ দই চারিদিকে তো তোমার থই থই! খেতে বললেই হত। না না, ওকেই ডেকে পাঠাই।
থাক মহা! বলেন জয়াবতী।
কিন্তু মহা থাকে না, সে ততক্ষণে কেষ্টাকে পাঠিয়ে দেয় ও বাড়ি।
পরের ছেলেকে নিয়ে আর জ্বালাতন কেন? জয়াবতী বলেন, ও তো আর আমার জন্যে কলকাতায় বসে থাকবে না, হয়তো আজই চলে যাবে।
আহা একবারও যদি একটু খাইয়ে দিতে পারে, প্রাণটা তবু রক্ষে হয় অমিতার। বিগলিত স্নেহে বলে মহাশ্বেতা।
.
তা বারেবারেই মহাশ্বেতার জয়।
তার অনুমানই ঠিক। পরের ছেলের হাতেই তখনকার মত প্রাণটা রক্ষা হল অমিতার। দুধ . একটু খেলো।
অতনু এসে প্রায় ধমক দেয়, কি হচ্ছে কি? না খেলে ডাক্তারবাবু এসে গলায় নল দিয়ে খাইয়ে দেবেন, তা জানো?
ও আমায় বকছে। বলে চোখ মুছতে থাকে অমিতা।
হ্যাঁ বকবে, সবাই তোমায় বকবে! অতনু বলে, না খেলেই বকবে।
তবে তুমি থাক! অভিমানে ভাঙা গলায় বলে অমিতা, তুমি বসে থাক, আমি খাব, ঘুমোব, চুপ করে থাকব।
আর কি, এখানে বসে থাকব! আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! অতনু বলে, সবাইয়ের কত কষ্ট হচ্ছে, মেসোমশাই কাল থেকে খাওয়া দাওয়া করেন নি, এ সব বুঝতে পারছ না?
আমি কি করব? আমার কি দোষ? আমায় কেন বকছ?
বলেছি তো সবাই বকবে। বলে অতনু সরে এসে বলে, শুনুন মাসীমা, বেশি আদর করে কথা বলবেন না, স্নেহ দেখালে আরও বেড়ে যাবে এই হচ্ছে এসব রোগের নিয়ম। ওর যেন কিছু হয়নি এই ভাব দেখাবেন।
জয়াবতী কেঁদে বলেন, আমরা তো দেখাব, ও যে এলোমেলো বকছে বাবা!
ঠিক হয়ে যাবে। ভাববেন না, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল। বললেন ভয়ের কারণ নেই।
তাই বল বাবা! মেয়ের দিকে তো চাইতে পারছি না আমি। কী মেয়ে কী হয়ে গেছে!
অধীর হবেন না, অধীর হবেন না।
ও কি, তুমি চলে যাচ্ছ বাবা?
যাই।
থাক না বাবা, দীপুর সঙ্গে বসে দুটো খাবে। কাল তো কিছুই খাওয়া হয় নি, সারারাত জাগা, কী কষ্টই পেলে?
অনেক বেশি কষ্ট আপনারা পাচ্ছেন মাসীমা! খাবার জন্যে কী? ওখানে বৌদি
বৌদিকে বোলো মাসীমা ছাড়লেন না। দেখছি, অমি তবু তোমাকে একটু ভয় করছে, অনেক দিন দেখে নি বলে হয়তো। আর একবার যদি ধমকে টমকে আর একটু খাইয়ে যেতে পারো!
অতনু কি যেন ভাবে।
ভয়ঙ্কর একটা দ্বিধার সঙ্গে যেন লড়াই করে, তারপর সহসাই নিতান্ত সহজ স্বরে বলে, ঠিক আছে থাকছি আমি। দেখি সারাদিন একটু ওয়াচ করে, ডাক্তারকে একটা রিপোর্ট দেবারও কথা রয়েছে। দীপু কোথায়?
কি জানি কোথায়! বলে জয়াবতী এই বেলা বারোটায় পূজোর ঘরে গিয়ে ঢোকেন।
দীপু কোথায়’ বলে খোঁজ করলেও দীপুকে কি অতনু খুঁজে বেড়াতে গেল?
না, কী দরকার অতনুর দীপুকে!
অতনু যদি এখন কাউকে খোঁজে তো সে নিজেকে। হ্যাঁ, ওই নীল রঙের পর্দা ফেলা ঘরটার দুর্নিবার আকর্ষণ এড়িয়ে অতনু এদিকের ঘরে এসে বসল নিজেকে খুঁজতে। পুরনো আমলের গেরস্থ বাড়ি, বাইরেটা কিছু বা গোছালো, ভিতরটা যেমন তেমন অগোছালো। একান্নবর্তী পরিবারের রীতি অনুসারে, কর্তাদের আয় উন্নতি যা হয় সেটা জানতে পারে গিন্নীদের বাপের বাড়ির দিক। বাড়ির লোক যদি কিছু টের পায়, সে হচ্ছে অপর পক্ষের ব্যক্তিগত বিলাসিতার বহর। সংসার নামক এজমালী জায়গাটা কিছুই জানতে পারে না। ভোগ করতে পায় না কারুর কোন আয় উন্নতির উপস্বত্ত্ব।
তাই এ বাড়ির কর্তাদের রোজগারপাতি যথেষ্ট হলেও, বাড়ির ভিতরে সেই পুরনো আমলের বিবর্ণ গৃহসজ্জা। লম্বা দালানে জায়গার অভাব নেই, কিন্তু বসবার মত গোছালো কোন ব্যবস্থা কোথাও চোখে পড়ে না। যত্র তত্র ছড়ানো ছিটানো না একটা টুল, একটা বেতছেঁড়া আরাম কেদারা, একটা তেপায়া চৌকী।