মূলকথা, কোন ধরনের গান এখন পাগলিনীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে সেটা অবশ্য শ্রোতব্য। ব্যাপারটা বিশেষ কৌতূহলের বইকি। কে বলতে পারে সেই গানের ভাষার মাধ্যমেই পাগলিনীর হৃদয়ের আরও কোনও জটিল রহস্য উদঘাটিত হয়ে পড়বে কিনা। দ্রুত একতলার ভাড়ার ঘর থেকে দোতলায় শোবার ঘরের দিকে ধাবিত হন তারা।
কিন্তু হায় হায়, অভিযান নিরর্থক।
অমিতা একা বিছানায় শুয়ে গাইছে কিনা–এবার কালী তোমায় খাবো!
আর গুনগুনিয়েও মোটেই নয়, রীতিমত উচ্চস্বরে। যদিও গলাটা ভেঙে গেছে, সুরটা এবড়ো খেবড়ো লাগছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, লাইন ভুলে যায় নি সে। মহোৎসাহেই গাইছে ও তোর ডাকিনী যোগিনী দুটো তরকারি বানিয়ে খাব, আর মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বলে সম্বরা দেব!
চিরপরিচিত এই রামপ্রসাদী গানের থেকে পাগলিনীর হৃদয়রহস্যের কোন কিছু আবিষ্কার করতে সমর্থ না হয়ে মহাশ্বেতা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। না, আশেপাশে কেউ নেই। বোধকরি জয়াবতী তখনো ঝিকামাইয়ের ঝড় ঠেলে স্নান সেরে উঠতে পারেন নি, পুরুষরা এদিক ওদিক নানা কাজে ব্যাপৃত।
সাহসে ভর করে ঘরে ঢুকে পড়ে মহাশ্বেতা। সেজমামীকেও একটা চোখটেপা কৌতুকের ইশারা করে ঘরে ঢুকতে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, ও কী বিচ্ছিরি গান গাইছিস অমি? একটু ভাল গান গা না? আগে তো কত ভালবাসার গান-টান জানতিস!
হঠাৎ পাগলিনী বিছানায় উঠে বসে হি হি করে হেসে উঠে বলে, এই যে! পেয়ে গেছি। ডাকিনী যোগিনী দুটোকে পেয়ে গেছি! এইবার তরকারি বানাই
বলা বাহুল্য শেষ অবধি আর দাঁড়িয়ে শোনবার সাহস হয় না দুজনের কারুরই। তড়াক করে উঠে বসা দেখেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাদের পিছনে পাগলিনীর উচ্ছ্বসিত হাসি যেন তাড়া করে ছোটে।
একটু আগেই সেজমামী সেজকর্তাকে বলছিলেন তোমরা যাই বল বাবু, আমার তো মনে হচ্ছে সাজা পাগল। এবং আরও যা মনে হচ্ছিল সেটা বলতে পারেন নি সেজকর্তার বিরক্তিব্যঞ্জক ভ্রূকুটিতে। কিন্তু এখন পিছনের ওই ভাঙা গলার উচ্চহাসি যেন বুকটাকে হিম করে দিয়ে নিঃসংশয় করে দিল তাকে।
ওদের ছুটে নেমে আসা, আর হাসির ধ্বনি, আবার বাড়ির অনেককেই একে একে ওই ঘরের আনাচেকানাচে টেনে আনে। বিয়ে উপলক্ষে আসা দেশান্তরের আত্মীয়-আত্মীয়াও আছেন কেউ কেউ, আছে চাকরবাকর, বাড়ির ছোট ছেলেপুলে।
দুঃখে কাতর বিষাদে ম্লান হয়ে নয়, সকলেই একটা কৌতুক কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকে, এই গতকালও এমন সময় যে মানুষটা সমস্ত সংসারটায় চরকির মত ঘুরে কাজ করে বেড়াচ্ছিল শান্ত হাসি মুখে, আজ সে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে আঙুল নাড়ছে, পা নাড়ছে, উঠছে বসছে, শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পাগলের মত কৌতূহলোদ্দীপক আর কী আছে?
পাগলের পাগলামীর ভিতর থেকে মানুষ সত্যই যেন কোন্ অজানিত রহস্যলোকের বার্তা আবিষ্কার করতে চায়। তাই সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে মুক্তা তোলার মত, অনর্থক কৌতূহলের প্রশ্নকে নামিয়ে নামিয়ে দেখে কোথায় গিয়ে ঠেকে। কোন প্রশ্নের হাতে উঠে আসে সেই রহস্যের মুক্তা।
কিন্তু সব নতুনই ক্রমশ নতুনত্ব হারায়, সব কৌতূহলেরই নিবৃত্তি আসে।
পাগলের চমকপ্রদ আচার আচরণে বেশিক্ষণ আর নতুনত্ব খুঁজে পায় না কেউ, যে যার আপন কাজে চলে যায়।
পৃথিবী বরং থেমে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন চাকা থেমে পড়বে না। তাই নিতান্ত প্রিয়জনবিয়োগেও শ্মশানের খাট আনার সময় ভাবতে বসে মানুষ কিছু খাদ্যবস্তু জোগাড় করে রেখে গেলে ভাল হত। নইলে এসে কি খাওয়া হবে?
অমিতা যদি কাল রাত্রে মারাই যেত, কজন আর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে পড়ে থাকত? যারা থাকত, তারাই বা কদিন থাকত?
আর এ তো শুধু অমিতার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
.
ক্রমশ সবাই চলে যায় দৈনন্দিন কাজে।
কাছে বসে থাকে শুধু নতুন বৌ আর দীপক। কার জন্যে কে বসে আছে, সে ব্যাখ্যা না করাই উচিত। পৃথিবীর সব রং মুছে ফেলেই বা লাভ কি?
জয়াবতী বলে গেছেন আমি এক্ষুনি আসছি। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে আসছেন না। দূরে কেষ্ট আর হরির সঙ্গে তার বচসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
এখন অমিত মুহুর্মুহু ঘুমোচ্ছে আর জাগছে।
মহাশ্বেতা দাঁড়িয়ে দেখে বলে, আমার পিস-শাশুড়ি ঠিক এমনি করেন, এই ঘুমোন, এই জাগেন। ইচ্ছে হচ্ছে বসে থাকি এখন, কিন্তু কি করব, যেতেই হবে আজ।
আবার হঠাৎ জেগে উঠল অমিতা। যেমন ধড়মড় করে ওঠে তেমনি উঠল ডাক্তার কোথা গেল? ডাক্তার? আমার কাছে একটু বসতে পারে না? এত কি কাজ তার? নতুন বৌ, ডাক্তারকে ডেকে আন না ভাই!
নতুন বৌ নতুন বরকে কি যেন ইশারা করে, তারপর সহসাই বলে ওঠে, ওই যে আসছেন।
সত্যিই ডাক্তার আসেন।
দুজন।
এ বাড়ির গৃহচিকিৎসক, ও আর একজন ভারী ভারী বয়স্ক ডাক্তার। মনোরোগের চিকিৎসক।
কাছে বসে শান্তগলায় বলেন, কই দেখি হাতটা।
আমাকে মারবে, আমাকে মারবে! বলে বালিশে মাথা ঘষটাতে থাকে অমিতা।
আবার ঘরে রথ দোলের ভিড়।
আবার এক ঝাপট নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
কেউ তোমাকে মারবে না! মারবে কেন, তুমি এত লক্ষ্মী মেয়ে!
তুতিয়ে পাতিয়ে নাড়ি দেখেন ডাক্তার, দেখেন বুক পিঠ। আলো ফেলে ফেলে দেখেন চোখের মণি। তারপর এদিকে সরে এসে বলেন খুব একটা ভয়ের কিছু দেখছি না আমি, সাময়িক হিস্টিরিয়া বলেই মনে হচ্ছে। তবে কোন রকমেই যেন উত্তেজিত না হয়। যা চাইছে সাধ্যমত সেটা পূরণ করবেন। ওষুধ দিচ্ছি আমি।