জয়াবতী কাতরভাবে অতনুকে বলেন, তাই দেবে নাকি বাবা আর একটু?
অতনু মাথা নেড়ে বলে, পাগল হয়েছেন। ডাক্তার আসুক।
.
মহাশ্বেতা সেজমামীকে গিয়ে বলে, দেখেছ তো, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই অতনু! এ সব অন্য পাগল! বইতে পড়ি তত ঢের!
সেজমামী এক ঢিলে দুই পাখী মারার কায়দায় বলেন, আমরা অবিশ্যি বই পড়ি না ঢের, তবে কিছু বুঝি বইকি। আর আজই নতুন বুঝছি না, অনেক কাল থেকেই বুঝছি। সেই এতটুকু বেলা থেকে ওই অতনুদা অতনুদা! ভাবে দেখাত যেন কিছুই না, এমনি ভাই-বোনের মত, কিন্তু জগতের আর সবাই তো অন্ধ নয়! অতনু এসে দাঁড়াল তো-মেয়ের মুখে চোখে যেন ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে উঠল! কোথায় না কোথায় আছে, যেই অতনুর গলার সাড়া পেল, সেইমাত্র যেন হঠাৎ না জেনে এসে পড়েছে এইভাবে এসে হাজির। সব সময় কিছু আর দৈবাৎ হয় না। তবু সত্যি কথা বলব, অতনু ছেলেটা চিরকালই সভ্য শান্ত। তা নইলে একটা লোক-জানাজানি কাণ্ড না হয়ে যেত না।
আর আমাদের বড়মামীটিকেও বলি–মহাশ্বেতা ঠোঁট উল্টে বলে, যেন ন্যাকা চণ্ডী! যেন দুনিয়ার হালচাল কিছুই জানেন না! বিধবা মেয়ে পাগল হয়ে পরপুরুষের নাম করছে তো তাকে সামনে ধরে দিতে হবে!
সেজমামী বলেন, এদিকে সংসারের বুদ্ধিতে তো কিছু কাঁচা দেখি না। সংসারে কে কাজটি করছে, আর কে আরামটি করছে, তার হিসেব কষতে তো নিক্তি হাতে নিয়ে বসে আছেন! এই আজই সকালে দেখলে তো?
দেখলাম বইকি! বলেই চুপ করে যায় মহাশ্বেতা। কারণ ছোট মামীকে আসতে দেখা যাচ্ছে।
ছোটমামী শত্রুপক্ষের কি মিত্রপক্ষের বোঝা শক্ত, তাই ছোটমামীকে একটু এড়িয়ে চলে মহাশ্বেতা।
কিন্তু মামারবাড়িতে মহাশ্বেতার শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষের প্রশ্ন কেন?
কেন, তার উত্তর অতীব প্রাঞ্জল। এ প্রশ্নের উত্তর বহুদিন আগে বিদ্যাসাগর দিয়ে গেছেন। বড়মামী জয়াবতীই চিরদিন ননদ ননদাই, ভাগ্নে ভাগ্নী, আত্মীয় কুটুম্বকে যথাযথ আদর আপ্যায়ন করে এসেছেন, তাই। মহাশ্বেতার যে ভাল ঘরে বিয়েটা হয়ে উঠেছিল, সেও বলতে গেলে বড় মামা মামীর সাহায্যে সহায়তায়। পাত্রপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী খরচ করবার সামর্থ্য মহাশ্বেতার বাবার ছিল না। জগন্ময় দিয়েছিলেন পণের নগদ টাকাটা, আর জয়াবতী নিজের দুখানা ভারী গহনা।
এই পাওয়ার ভারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলা শক্ত। ঋণের জ্বালা বড় জ্বালা! আবার যে ঋণ শোধাও যায় না, ভোলাও যায় না, তার আগুন তুষের আগুনের মত! গুমে গুমে পোড়, আর ঋণদাতাকেই সেই ভস্মের কালি মাখাতে চায়।
মহাশ্বেতা জানে বড়মামী না থাকলে সেজমামী ছোটমামী তাকে কোনদিন ডেকে এক গেলাস জলও খাওয়াবে না, তাই যত কিছু খোসামোদ তাদের খাতেই ব্যয় করে।
বিজয়ের বৌ নন্দা এসে বলে, মহাশ্বেতা, তুমি আজ সকালেই নাকি চলে যাবে?
মহাশ্বেতা সনিশ্বাসে বলে, না গিয়ে তো উপায় নেই। ছেলের আজ থেকে পরীক্ষা শুরু। তবে এ বাড়ির যা অবস্থা দেখছি, ইচ্ছে হচ্ছে না যে যাই।
নন্দা অগ্রাহ্যভরে বলে, অবস্থা আর কী এমন? মানুষের অসুখ করে না?
করবে না কেন? মহাশ্বেতা করুণাঘন কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক অসুখ হলে কে আর এত ভাবত? এ যা হলো, তাতে বড়মামীর জীবন তো চিরদিনের মত মহানিশা হয়ে গেল।
নন্দা আর একবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করল, চিরদিনের মত আবার কি? হিস্টিরিয়া হয় না কারুর? দেখনি কখনো?
কি জানি ভাই ছোটমামী, তোমার বাপের বাড়ির মস্ত সংসার, বিরিঙ্গী গুষ্টি, তুমি অনেক দেখে থাকবে, আমরা তো কই এতখানি বয়সে এমনধারা হিস্টিরিয়া দেখি নি। আর এখনো সেই অতনু অতনু করছে তো?
নন্দা উদাসীন মুখে বলে, কি জানি ভাই অত দেখি নি। তবে অতনুকে ওখানে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম বটে। হয়, হিস্টিরিয়াতে ওই রকম হঠাৎ একজনের ওপরই ঝোঁক হয়।
তা হবে। বলে মহাশ্বেতা সেজমামীকে মধ্যস্থ মানে, তোমার কি মনে হয় সেজমামী? লোকলজ্জাই যদি ঘুচে গেল, তবে আর পাগল হওয়ার বাকী রইল কি?
নন্দা গম্ভীর মুখে বলে, পাগল আর এ জগতে কে নয়?
কথাটা এমন একটি উচ্চাঙ্গের দার্শনিক ভাবাশ্রিত যে, ওর ওপর আর কথা চলে না। তবে প্রশ্ন একটা থেকে যায় যে, তাহলে ধরে নিতে হবে জগতের সবাই লোকলজ্জামুক্ত।
ওদের কথার মাঝখানে হি হি করে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ায় বাড়ির রাঁধুনী বামুন মেয়ে।
আজ তার নিত্য কাজের ছুটি। কারণ আজও যজ্ঞির দরুন বামুনদেরই একজনের বাঁধবার কথা। তাই ছুটির আনন্দে গড়াতে গড়াতে এসে বলে সে, দিদিমণির কাণ্ডখানা শুনেছ সেজমা?
কিগো, আবার কি? নতুন কি?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঙুল নাড়ছে আর গান গাইছে।
গান গাইছে!
কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন সেজগিন্নী যে মনে হওয়া স্বাভাবিক, অমিতার গান গাওয়ার মত অঘটন ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। বামুন মেয়ে বাকী বক্তব্য শেষ করে, আমি যেই গিয়ে জানলায় উঁকি দিয়েছি, অমনি এই মারে তো এই মারে। বলে কি, কে? কে ওখানে? পুলিশে দেব তা জানো? আমার ঘরে যে আসবে তাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেব। বলেই আবার গান।
মহাশ্বেতা সন্দিগ্ধভাবে বলে, কী গান গাইছে?
তা জানি না বাপু!
যাই তো শুনে আসি। বলে অঙ্গ তুলে উঠে পড়ে মহাশ্বেতা। সঙ্গে সঙ্গে তার সেজমামীও। সকৌতূহলে বলেন, আহা, পাগল ছাগল যা হয় হোক, তবু তো একটু গাইছে। গান তো ভুলেই গিয়েছিল। যাই তো শুনিগে একটু।