এমন কি নতুন বৌয়ের ওপরও রাগ এসে গেল জয়াবতীর। রোদ উঠে দালান ভরে দিল, ফুলশয্যার কনে এখনো বরের ঘরে শুয়ে! ছি ছি ছি! জয়াবতীরা এ রকম করতে পারতেন?
বিয়ের দুচার বছর পর পর্যন্তও যে জয়াবতী কাক-কোকিল ডাকার আগে উঠে পড়ে আপন শয়নমন্দির ত্যাগ করে যেখানে সেখানে এসে পড়ে থেকেছেন, এতদিন পরেও সেটা মনে পড়ে গেল।
নতুন বৌ তার কোন্ কাজে এখন লাগবে সে কথা স্মরণ না করেই রাগে জ্বলতে থাকলেন জয়াবতী। জ্বলতে জ্বলতে সেজ এবং ছোট জায়ের ঘরের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সশব্দ স্বগতোক্তি করে উঠলেন, রাত করে ঘুমিয়েছে সবাই, আমিও কিছু সন্ধ্যে থেকে ঘুমুচ্ছি না। আমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে গেছে, আমি জানি আর ভগবান জানেন।
ভগবান অবশ্য সমর্থন কি প্রতিবাদ কিছুই জানালেন না। বন্ধ দরজাগুলি থেকেও কোনও সাড়া এল না।
জয়াবতী স্বর আর একটু উচ্চগ্রামে তুললেন, আমারই বা কী দায়! আমি আমার অসুখ মেয়ের কাছে শুয়ে পড়ে থাকিগে। যেখানে যেমন আছে থাকুক পড়ে। দরকার সকলেরই আছে, ভাত সবাই খাবে, আমি একাই খাব না!
আরও হয়তো কিছু বলতেন, কিন্তু বাধা পড়ল। কোন্ ঘর থেকে যেন অতনু উঠে এল রাঙা রাঙা চোখে। বলল, কাকীমা! ওখানে কে একটা মেয়ে বোধহয় আপনাকে খুঁজছে।
মেয়ে! এই সকালবেলা জয়াবতীকে খুঁজছে! ভয় পেয়ে গেলেন জয়াবতী, কি রকম মেয়ে?
অতনু ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমন কেউ না। এই ঝিটিয়ের মেয়ের মত!
অ্যাঁ, ঝিয়ের মেয়ে!
ভয় চরমে ওঠে। ভূতের বাঘের সাপের সব কিছু ভয়ের বাড়া ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন জয়াবতী।
তাহলে নির্ঘাৎ মাগী আসতে পারবে না বলে খবর পাঠিয়েছে! ও অতনু, আমি কি করি বাবা! …কে রে কে? লতিকা? কী? কী খবর শুনি।
মা বলল আসতে পারবে না, জ্বর–গা হাত পা ব্যথা–পেটের অসুখ—
ফিরিস্তি বড়, তার মানে অন্তত দিনতিনেকের মত!
বিয়ের বকশিশ, তত্ত্বর পাওনা, সবই যখন পাওয়া হয়ে গেছে, আর এত কষ্টর দরকার কি?
জয়াবতী ভয়ঙ্কর স্বরে বলেন, তোদের ওসব মিছে কথা আমি শুনতে চাই না। মাকে বলগে যা, যেতে বলেছে, নইলে চাকরি থাকবে না।
না থাকে না থাকবে! বছর এগারোর মেয়েটা একান্ন বছরের মুখের ওপর ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, তা বলে তো আর মরে মরে কাজ করতে পারবে না? না পোষায়, আপনারা লোক দেখ।
খরখর করে চলে যায় সে, ছিটের ফ্রক দুলিয়ে।
অতনু সামনে, নচেৎ বোধকরি ডাক ছেড়েই কাঁদতেন জয়াবতী, একটু সামলালেন। কিন্তু কথা যা বললেন ডুকরে কেঁদে ওঠার মতই।
দেখলে অতনু দেখলে! কী সব আসপদ্দা হয়েছে! ওই আমার একটা রুগী মেয়ে কাল থেকে–খাওয়া না-দাওয়া সহসা জয়াবতীর আক্ষেপোক্তি চাপা পড়ে যায় একটা ডুকরে ওঠা কান্নার তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দে।
টানা করুণ সুর। অমিতার গলা বলে চেনবার উপায় নেই।
সর্বনাশ করেছে! ছুটে এগিয়ে গেলেন জয়াবতী।
.
মুহূর্তে ঘরে ঘরে দরজা খুলে যায়। বিয়ের বর ফুলের আর সিঁদুরের দাগে কলঙ্কিত গেঞ্জিটা গায়ে দিয়েই ছুটে বেরিয়ে আসে, কনে ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
আবার সেই প্রশ্ন
কি হয়েছে মা, কি হয়েছে?
অমিতার চুল এলোমেলো, কাপড় এলোমেলো, চোখ রাঙা, চোখভর্তি জল। ভাঙা ভাঙা গলায় কাঁদছে সে, আমায় ফেলে সবাই চলে গেল। ডাক্তার আমায় ওষুধ দিল না!
সম্পূর্ণ উন্মত্ততা! সম্পূর্ণ উন্মাদিনীর চেহারা!
দেবে মা, ওষুধ দেবে।–জগন্ময় বলেন, আমি এই তোমার সেজকাকামণিকে পাঠাচ্ছি, ভাল ডাক্তার ডেকে আনতে। খুব ভাল ওষুধ দেবেন তিনি, ভাল হয়ে যাবে তুমি।
উন্মাদিনী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, বাপের হাতটা চেপে ধরে শিথিলকণ্ঠে বলে, সেদিন যে ডাক্তার ওষুধ দিল! সব কষ্ট সেরে গেল। সে কবে চলে গেল বাবা?
কার কথা বলছ মা? অতনুর? এই তো, এই তো সে তোমার মার কাছে দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছ না?
ওঃ আচ্ছা! বলে যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে অমিতা।
নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে সবাই।
কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা? ক্ষণপরেই ভুরু কুঁচকে ওঠে অমিতার, ঠোঁট কাঁপতে থাকে, নাকের ডগা ফুলে ফুলে ওঠে। পূর্ণ বিকারের লক্ষণ।
ব্যস আবার কান্না!
সক্কলে কেন আমায় জ্বালাতন করছে বাবা?
সেজকাকা এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধমকের সুরে বলেন, কই তোমাকে জ্বালাতন করছে?
ও মা গো, আমায় বকছে! চীৎকার আরও তীব্র হয়ে ওঠে, সব্বাই আমাকে ধরছে, আমার ঘর অন্ধকার করছে।
ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো সবাই। জগন্ময় বলেন, আর বিজয়, তুই একবার আমাদের ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে অবস্থা বুঝিয়ে, কোন স্পেশালিস্টকে আনাবার ব্যবস্থা কর ভাই! আমার তো আর হাত পা উঠছে না।
আমার সেই ছেলেটা! পাগলিনী চেঁচিয়ে ওঠে, কোথায় গেল সে?
ছেলেটা! সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করে।
ছেলেটা কে মা অমি?
সেই যে–খুব ভাল ছেলেটা! বিয়ে হল, টোপর পরল—
ও দীপুকে ডাকছ? আয় দীপু সরে আয়। এই তো, এই যে! তোমার ভাই, ছোট ভাই।
চোখভর্তি জলসুদ্ধু খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অমিতা, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাই ভাই! আমি বড্ড ভুলে যাই, না বাবা?
দীপকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে খানিকক্ষণ আবার চুপ করে থাকে অমিতা, তারপর আস্তে আস্তে বলে, একটা ডাক্তার এসেছিল সে কোথায় গেল রে? আমায় খুব ভাল ওষুধ দিলে, সব কষ্ট কমে গেল। ওকে বল না রে, তোমার পায়ে পড়ি, আর একটু সেই ওষুধ দাও।