গেরস্থর কাজ করবার অনেক লোক আছে। বলেছিল অমিতা।
তাই শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছ?
না, শুধু শুধু তো দাঁড়িয়ে নেই!
কি করছিলে তাহলে?
অমিতা চোখ তুলে বলেছিল, অপেক্ষা!
অপেক্ষা? কিসের? ভারি যেন আশ্চর্য হয়েছিল অতনু।
আর সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব বদলে গিয়েছিল অমিতার। গভীর থেকে তরলে, বিষণ্ণতা থেকে উচ্ছলতায়।
কিসের? তাও বুঝিয়ে দিতে হবে? আশ্চর্য! অপেক্ষা করছিলাম খাবার ডাকের। বাড়ির লোকদেরও যে খিদে পায় এটা কারও মনে পড়ে কিনা তাই দেখছিলাম নিঃশব্দে।
লুচির খিদে!
প্রায় ধিক্কার দিয়ে বলে উঠেছিল অতনু। আর অমিতা হেসে উঠে বলেছিল, তা ওর থেকে সূক্ষ্ম ক্ষুধা বোধ হলেই বা লাভ কি? বোঝে কে?
তারপর আরও কি কি কথা হয়েছিল মনে নেই অতনুর। বোধকরি ছোটকাকার ছেলেকে তার মামার বাড়ি থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা গিনির মালা দিয়েছিল তারই ব্যাখ্যা করেছিল অমিতা। তারপর আরও কত কি!
তবু সেদিন অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়েছিল অতনু এটা মনে আছে, কিন্তু এ বাড়িতে কোনদিন রাত কাটায় নি অতনু। আজও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। আজ রাত কাটাবে।
ইচ্ছে করলেই বসা যায়। কত কিই তো রয়েছে বসবার মত। তবু দাঁড়িয়েই আছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে পায়চারি করতে সুরু করা যায় কিনা। আর যদি তা যায়, তাহলে দালানের ও প্রান্তের ওই ঘরটার খোলা জানলাটার সামনে দিয়ে একবার ঘুরে আসা যায় কি না। যে জানলাটা দিয়ে শুধু ও ঘরের ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডটার একাংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা মনে এল অতনুর। মনে হল, এ বাড়িতে একদিন রাত কাটাতে পারত সে, যদি সে এমনি কোনও উৎসবের কেন্দ্র হয়ে আসত, ফুলের মালা আর টোপর পরে।
২. উৎসবরাত্রি
উৎসবরাত্রির পরবর্তী সকালটায় সংসারের চেহারাটা থাকে যেমন শ্রীহীন তেমনি অরুচিকর। এ যেন শত্রুপক্ষের সৈন্য-অধ্যুষিত শহর। সৈন্যরা চলে গেছে, কিন্তু যথেচ্ছ রেখে গেছে তচনচ করা অসম পদচিহ্নের স্বাক্ষর।
অথচ চাঙ্গা হয়ে উঠে তখুনি আবার সব ঠিক করার উৎসাহও কারও থাকে না। মিটে গেছে তো কাজ, নিভে গেছে তো সমস্ত বাড়তি আলো, আবার তবে এখুনি ওঠাবার কি আছে?
উৎসব-ক্লান্ত রাত্রির শেষে অলস ঘুমে আচ্ছন্ন প্রাণীগুলো যখন চোখ খুলেই একবার আজকের হালকা মাথাটার অপূর্ব সুখ অনুভব করে ফের পাশ ফিরে ঘুমোয়, তখন তাদের দেখে মনে হয়, জীবনে বুঝি ওদের এইটা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না, অতএব জীবনের সব কর্ম সমাধা হয়ে গেছে, এবার নিশ্চিন্তে অনন্ত নিদ্রা দিতে পারে।
কিন্তু ঘুম থাকে না গৃহিণীর। সংসারের যিনি কর্ণধার।
তিনি জানেন গত দিনের চাইতেও আজকের কর্তব্যকর্ম অনেক কঠিন! আজ জোয়ার নেই, শুধুই ভঁটা।
সকলকে চালাতে হবে নিরুৎসাহের ভাটা ঠেলে ঠেলে। আজ কাউকে কোনও কাজ বললেই
বাড়ির লোকেরা ক্লান্তির চরম অভিব্যক্তি দেখাবে, এবং মাইনে করা লোকেরা মেজাজের চরম নমুনা দেখাবে।
এ ছাড়া প্রত্যেকের মুখেই শুনতে পাওয়া যাবে, তারা কিছুই দেখে নি, কিছুই খায় নি।
কারণ?
কারণ আবার কি, তারা তো শুধু খেটেছে। অতএব আবার ভাল খাওয়াও এবং বকশিশের লোভ দেখিয়ে তবে তাদের কাজে নামাও! চোখ রাঙিয়ে কাজ আদায় করার দিন এখন চলে গেছে। কী দাসদাসী, কী পরিজন, সবাইকে তোয়াজ করতে হবে। নচেৎ ছাদের এঁটোকলাপাতা সন্ধ্যা অবধি উড়বে, এখানে সেখানে স্তূপীকৃত মাটির খুরি-গেলাসগুলো সারাদিন কাকে ওলটাবে, আর গতরাত্রের পাতা শতরঞ্চি আর অস্থায়ী বিছানাগুলো আবার আজ রাত্রের দরজায় পৌঁছবে!
যায়, সবাই শিথিল হয়ে যায়। এমনিতেই উৎসব-অন্তে এরকমই হয়ে থাকে, আর দীপকের বৌভাতের রাত্রের ব্যাপার তো আরওই।
রাত তিনটে সাড়ে তিনটেয় সবাই ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা কে উঠবে?
কিন্তু উঠলেন। জয়াবতী উঠলেন।
মনে পড়ল আজ অমিতা কিছু পারবে না, অমিতা বিছানায় পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণটা হাহাকার করে উঠল, অমিতা কি আর কোনদিনই তেমন করে পারবে? তেমন করে করবে? জয়াবতীকে বেলা আটটা অবধি বিছানার কোমল স্পর্শ অনুভব করতে দিয়ে সংসারের চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাইয়ের কাজে আত্মনিয়োগ করবে?
না না, ভগবান জয়াবতীর সব সুখ কেড়ে নিলেন!
জয়াবতী উঠলেন, সাবধানে নিঃশব্দে, অমিতার পাশ থেকে! সে ঘুমোচ্ছে অঘোরে।
উঠে এসে একবার চারিদিক দেখলেন, এখুনি যদি কেউ ঝাটা ন্যাতা আর জলের বালতি নিয়ে নেমে না পড়ে তো আজকের আহার আয়োজনের বারোটা বেজে যাবে। ডাকলেন চাকর কেষ্টকে। বাবা বাছা বলেই ডাকলেন, সে একটা উ ধরনের শব্দ করে আবার পাশ ফিরল।
আশ্চয্যি! যত সুখ আমার দেখেছে! বলে পুরনো চাকর হরিকে ডাকলেন বেশ উষ্ণ ভাবেই। উত্তরে হরি গায়ে চাদরটা ভাল করে টেনে নিয়ে জড়ানো গলায় যা বলল তার অর্থ এই দাঁড়ায় তার মাথায় অসহ্য যাতনা তার কোমরে অসম্ভব বেদনা, অতএব
তোরা ভেবেছিস কি? এই বাড়ি কি তবে আমি পরিষ্কার করব? প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন জয়াবতী, সবাই যে যার আয়েস করে ঘুমোতে থাকলেন, যত জ্বালা আমার! কী চোরদায়েই আমি পড়েছি!
এই সবাইটা অবশ্য চাকরবাকর নয়, লক্ষ্যস্থল আরও ব্যাপক। সেজ আর ঘোট দুই জা আছে, অছেন বড় ননদ আর ভাগ্নী, জায়েদের আইবুড়ো মেয়েরাও আছে।
সকলেই ঘুমে অচেতন। কেন? কেন?