ছেলেবেলার সেই দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি উঠে তিনতলার ছাতে গিয়ে প্রবল দৌরাত্মটা অবশ্য সেরে গিয়েছিল নমিতার বিয়ের পর। কারণ সে খেলার প্রধান অংশীদার ছিল নমিতা। বয়সের হিসেবে নমিতাই তো বরং অতনুর সমান সমান। বড় জোর যদি এক আধ বছরের বড় হয় নমিতা। তখন নমিতা আর অতনু ওদের হাঁটুর বয়সী অমিতাকে কী কৃপাদৃষ্টিতেই না দেখত! খেলায় যদি নিত তো সে নেহাই ক্ষ্যামাঘেন্না করে।
তারপর কেমন করে কোথা দিয়ে যে সেই ভাবনাহীন বাল্য-কৈশোরের উজ্জ্বল শাদা দিনগুলো হু হু করে পার হয়ে গেল, কোথা থেকে এল রঙিন ভাবনা, আর ভাবনায় রাঙা দিন! কোথা থেকে কেমন করে সেই হাঁটুর বয়সী মেয়েটা ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরে এক অপরূপ আকর্ষণের মহিমা নিয়ে চোখের সামনে ঝলসে উঠল।
কিন্তু সেই ঝলসানিতে কি দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অতনুর? শোভন অশোভনতার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল? না, ঠিক তার উল্টো। বরং শোভনতা বোধের মাত্রাটাকে অতনু যেন বাড়িয়েই তুলেছিল।
নইলে কেউ তো ওকে কোনদিন মুখে ফুটে বলে নি, তুমি আর এ বাড়িতে ঘন ঘন এসো না অতনু, আমাদের ঘরে বড় মেয়ে। অথবা এ-ও বলে নি, অতনু তুমি বড় হয়েছ, বেড়াতে এলে নীচে বসবার ঘরে বসাই তো উচিত। দোতলায় ওঠার দরকার কি?
না না, তেমন দোষারোপ করা যায় না এঁদের উপর। অতনু নিজে থেকেই যখন তখন আসা কমিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছেমত দোতলায় ওঠা বন্ধ করে দিয়েছে। যখন এসেছে, হয়তো নীচে বসবার ঘরে বসে জগন্ময় হিরন্ময় বিজয়ের সঙ্গে কথা বলে চলে গিয়েছে। হয়তো বা ভিতরে এসে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, কী কাকীমা, কি করছেন?
অবিশ্যি কাকীমারাও কোনদিন হৃদয় বাড়িয়ে দিয়ে বলেন নি, তুমি আর তেমন যখন তখন আস না কেন অতনু? আসবে, দোতলায় উঠে যাবে, বসবে, গল্প করবে। পরের মত বাইরে থেকে চলে যাও কেন?
আসল কথা, তেমন কথা বলবার খেয়ালই হয় নি কারুর। ছেলেটা ছোট ছিল, পড়শীর বাড়ি এসে হুড়োহুড়ি করত। এখন বড় হয়েছে, সভ্য শান্ত হয়েছে, বাইরে বেটাছেলেদের সঙ্গে কথা বলে চলে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে হায় হায় বোধ আসবে এমন আদিখ্যেতাওয়ালা মন তাদের কারুরই নয়।
আর মহাশ্বেতা যখন মাঝে মাঝে মামার বাড়ি আসত, তখন তো অতনু এ বাড়ির ছায়াও মাড়াতো না। ভারি ভয় লাগত ওর মহাশ্বেতাকে। অথচ কোনওদিনই কিছু বলে নি তাকে মহাশ্বেতা। শুধু সেই একটি দিন!
তা সেই বা এমন কি!
অতনু এ বাড়িতে এসেছিল, আর সামনেই অমিতাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, কাকাবাবু কোথায় অমিতা?
যেন কাকাবাবুর কথা ভেবেই সারারাত ঘুম আসে নি অতনুর। আর কাকাবাবুর জন্যেই উদ্বেল হয়ে ছুটে এসেছে।
দুষ্ট অমিতা হেসে উঠে সেই প্রশ্নই করেছিল। বলেছিল, সক্কালবেলাই বাবাকে খুঁজছ যে, কী দরকার? রাতে স্বপ্ন দেখেছ বুঝি?
স্বপ্ন! হ্যাঁ, স্বপ্ন তো দেখেইছি। অতনুও হেসে বলেছিল, ঘুম হয় না অথচ স্বপ্ন দেখি, এ কী অদ্ভুত রহস্য বল তো?
ঘুম আবার হয় না! অপূর্ব ঝঙ্কারে হেসে উঠে বলেছিল অমিতা, রাত্তির নটা থেকে সকাল
ছটা পর্যন্ত তো স্রেফ নাসিকাধ্বনি।
বটে! গিয়ে দেখে আসো বুঝি?
যেতে হবে কেন? এ বাড়ি থেকে শব্দ কানে আসে যে!
অতনু এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক্ করে বলেছিল, এমন তো হতে পারে, সেটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
উত্তরটা আর শোনা হয় নি। হঠাৎ দেখা দিয়েছিল মহাশ্বেতা, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নীচের উঠোনটা দেখছে।
মৃদুস্বরে বলেছিল অতনু, পালাও। আশেপাশে প্রহরীর চক্ষু। আর গলা তুলে বলেছিল আচ্ছা আমি তাহলে ও বেলা আর একবার আসব। দরকার আছে কাকাবাবুর সঙ্গে।
উৎসববাড়ির গোলমালের সুযোগ না থাক, একান্তে দেখা হলে এ রকম বা এ ধরনের বাক্য বিনিময় তাদের হত। কিন্তু তার বেশি আর কিছু নয়। আর বেশি উদ্ঘাটিত করে নি কেউ নিজেকে। কি করেই বা করবে? আশৈশবের পরিচয়ই যে সেই নতুন উদঘাটনের বাধা।
স্থান কাল পাত্র গভীর সুরে গভীর কথা শোনাবার মত ছিল না।
কিন্তু মহাশ্বেতার সন্ধানী দৃষ্টি সেই হাল্কা সুরে বলা হালকা কথা কটির মধ্য থেকেই আবিষ্কার করে বসেছিল এক গভীর তথ্য। তাই বলে ফেলা কথা রাখতে অতনু যখন ও বেলা এসে আবার জগন্ময়ের খোঁজ করেছিল, তখন পড়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতার কবলে।
মহাশ্বেতা কিন্তু বিশেষ কিছুই বলে নি। শুধু নেহাৎ নিরীহ সুরে বলেছিল, তুমিই অতনু? আগে তো তোমার নমিতার সঙ্গে খুব ভাব ছিল, তাই না? এখন বুঝি অমির সঙ্গে ভাব?
অতি তুচ্ছ একটি প্রশ্ন।
তবু সেই থেকে মহাশ্বেতা মামার বাড়ি এসেছে এ খবর টের পেলে এ-মুখো হত না অতনু। আর ক্রমশ তখন অমিতার কলেজ যাওয়া আসার পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
তারপর নমিতা মারা গেল। বাড়িতে শোকের ছায়া পড়ল।
একটু গম্ভীর হয়ে গেল অমিতা, একটু ম্লান হয়ে গেল অতনু। আর সেই সময় চলতে লাগল অমিতা-পারের তোড়জোড়।
ছেলেবেলা থেকে কত ঘটনা কত ছবি! সব ঘটনাগুলো যেন সাম্প্রতিককার মত কাছাকাছি এসে ভিড় করছে! সব ছবিগুলো যেন গতির চাঞ্চল্য পেয়ে চোখের সামনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে!
দোতলায় ওঠা বন্ধ করে ফেলেছিল, তবু একদিন সন্ধ্যায় এই বারান্দায় দেখা হয়েছিল অমিতার সঙ্গে। সেদিনও এ বাড়িতে কী যেন উৎসব ছিল। বোধহয় বিজয়ের প্রথম সন্তানের অন্নপ্রাশন। নেমন্তন্ন খেতে ছাতে উঠে, সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে না গিয়ে, যেন ছিটকেই এদিকে চলে এসেছিল অতনু। এখানে দাঁড়িয়ে ছিল অমিতা। অতনু বলেছিল, কোনও কাজই তো করতে দেখছি না। পানটা পরিবেশন করলেও গেরস্থর কিছু করা হত।