শুয়ে থাকতে থাকতে সরোজাক্ষ শুনতে পেলেন তিনতলায় সিঁড়ি থেকে বিজয়া সশব্দে স্বগতোক্তি করছেন, পোড়ারমুখো কলেজে কি রোজই মিটিং? এই এতখানি রাত হল, এখনও মিটিং চলছে? ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!
ধন্যবাদটা কাকে দিচ্ছেন বিজয়া তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। সরোজাক্ষকে, না কলেজ কর্তৃপক্ষকে, কে জানে!
সরোজাক্ষ তবু উঠে পড়ে সাড়া দিলেন না, যেমন পড়ে ছিলেন, পড়ে রইলেন। কিন্তু একটু পরেই ঘরের মধ্যে পদশব্দ। তার সঙ্গে একটা উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, দাদা, এসে শুয়ে পড়লেন যে? শরীর খারাপ হয়নি তো?
বন্ধ চোখটা খুললেন সরোজাক্ষ, আর কেন কে জানে হঠাৎ চোখ দুটো তাঁর জ্বালা করে উঠল।
উঠে বসলেন।
সহজ গলায় বললেন, না না, শরীর ঠিক আছে।
অনেক দেরি হল। মিটিং ছিল বুঝি?
সরোজাক্ষ একবার ওর দিকে তাকালেন, কেমন একটু হেসে বললেন, না, ওরা আমায় আটক করেছিল।
আটক! ওরা! কারা?
সারদাপ্রসাদ অবাক গলায় তাকায়।
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ছেলেরা! আমার ছাত্ররা। ঘেরাও করেছিল, ক্ষমা চাইয়ে তবে ছেড়ে দিল।
সারদাও হেসে বলে, ধ্যাৎ কী যে বলেন! ঠাট্টা করছেন।
ঠাট্টা নয় হে, সত্যিই!
সারদা বলে, সত্যি! আপনি ক্ষমা চাইলেন, এই কথা বিশ্বাস করব আমি?
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, আধুনিক জগতে অবিশ্বাস্য বলে কোনও কথা নেই সারদা! ওটা সেকেলে হয়ে গেছে।
সারদা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, ওটা সেকেলে হয়ে গেছে? ভারী বড়াই আধুনিক যুগের। বলি কীসের বড়াই? চাঁদে গুতো দিতে যাচ্ছে বলে? বলি প্রাচীনকালের পুরাণ, উপপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, এসব খুলে দেখেছে আধুনিক যুগ? দেখেনি, দেখে না। দেখলে বুঝতে পারত চাঁদ তো তুচ্ছ কথা, ইন্দ্রলোক বরুণলোক বায়ুলোক,–এমনকী গোলোক পর্যন্ত ফটফটিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। অবশ্য হরে নরে যদু মধুরা কি আর? তারা একাল সেকাল চারকালেই এক। বেড়াতেন যোগসিদ্ধরা। যোগসিদ্ধ বলতে কী বোঝায়? বিজ্ঞানসিদ্ধ। স্রেফ নামের পার্থক্য। একাল বলে বিজ্ঞান, সেকাল বলত যোগ। যোগটাই উপযুক্ত নাম। যোগঅর্থাৎ মনঃসংযোগ। তাই মনঃসংযোগের ফলেই বস্তুতে বস্তুতে রাসায়নিক যোগ, দুরের সঙ্গে নিকটের যোগ।
এসব কথা অবশ্য সরোজাক্ষর শতবার শোনা, তবু ওই উৎসাহ-প্রদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, তাই তো, এটা তো সত্যি ।
বলতেই হবে সত্যি– উদ্দীপ্ত মুখ আরও উদ্দীপ্ত হয়, তবেই বলুন, বড়াইটা তোরা করছিস কী নিয়ে? বিজ্ঞান দেখাচ্ছে। আরে বাবা, এ যুগ তো বিজ্ঞানের অ আ ক খ শিখছে, আর সেকালের যোগীঋষিরা? তার অনুস্বর বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু সব শেষ করে ফেলেছিল। নারদ ঋষি ঢেঁকি চড়ে ত্রিভুবন পয়লট্ট করে বেড়াত। সেই চেঁকিটি কী?
সারদাপ্রসাদ রহস্যব্যঞ্জক হাসি হেসে বলে, লিখব সেকথা! ঢেঁকিটি আর কিছুই নয়, একটি পাওয়ারফুল হেলিকপ্টার। সেইটিতে চেপে শূন্যে ঘুরত, নীচে থেকে চাষা-ভুষোরা বলাবলি করত ঠিক যেন ভেঁকি। সেই থেকে ওইটাই চলিত হয়ে গেছে।-মনোরথ মানে কী? ওই বস্তু।–উঃ ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় দাদা–সারদা যেন ছটফটিয়ে ওঠে,আধুনিক বিজ্ঞান এক একটা রকেট ছুঁড়ে মনে করছে কী বাহাদুরিই করলাম! আর সেকালে? গ্রহে গ্রহে যাতায়াত, আদানপ্রদান, এসব কিছুই নয়। ধরুন, বৃহস্পতি গ্রহের একটা ছেলে শুক্র গ্রহে এসে লেখাপড়া করল, প্রেম করল, কত কীর্তিই দেখাল। বিজ্ঞানের কতখানি উন্নতি হলে তবে এসব সম্ভব বলুন? এ যুগের তোরা তো বড় বড় মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে মনে করছিস কী কাণ্ডই করলাম, আর সেকালে? মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী অমর হওয়ার মন্ত্র!
সারদা পায়চারি করে বেড়ায়, মাথার চুলটা মুঠো করে চেপে ধরে, ভাবলে জ্ঞান থাকে? বলুন?
সরোজাক্ষ খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলেন, তবু মৃদু হাসলেন, না না, জ্ঞানটা রাখা দরকার। ওটা হারানো ঠিক নয়।
দরকার তো বুঝলাম, কিন্তু থাকে কই? যখনই চিন্তা করি, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। এই আমরা ভারতবর্ষের লোক আজ যেন ভিখিরি। আমাদের কিছু ছিল না, কিছু নেই। আমরা মূর্খ, অজ্ঞ, হা-দেখলে! অথচ আমাদের সবই ছিল।
সরোজাক্ষ বিষণ্ণ গলায় বলেন, কী ছিল তা জানি না সারদা, তবে এখন যে কিছু নেই তা জানছি।
সারদা দৃঢ় গলায় বলে,শুধু সেটা জানলেই তো চলবে না, তার প্রতিকার করতে হবে। জগৎ সমক্ষে এইসব প্রমাণপত্র নিয়ে গিয়ে গিয়ে দাখিল করে তাদের তাজ্জব করে দিতে হবে। কী করে রাষ্ট্রদূতেরা? দেশের পয়সা খরচ করে বিদেশে বসে থেকে? শুধু বিলাসিতা, শুধু দেশের নাম ডোবানো, এই তো? কেন, দেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে নিয়ে যেতে পারে না এইসবনজির? বলতে পারে না ভারী তোরা আজ বিমান যুদ্ধের বড়াই দেখাস, মেঘনাদের নাম শুনেছিস? জানিস রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল কীসে চেপে? পুষ্পকরথ শব্দটার অর্থ কী? না, তা বলবে না, শুধু বিদেশে গিয়ে এই গরিব দেশের পয়সায় লঞ্চপানি করবে, মদ খেয়ে বেহেড হবে।
সরোজাক্ষর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, সরোজাক্ষর আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু বললেন, এক কাজ করো সারদা, এই নিয়ে নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলল।
আপনি বলবেন তবে লিখব? সারদা হাসে, এ সবই তো তৈরি! নেহাত কাটাকুটি তাই আপনাকে পড়তে দিতে পারছি না, নচেৎ দেখিয়ে দিতাম কীভাবে হেনস্থা করেছি ওদের। মানে ওই আমাদের দেশের কেষ্ট-বিষ্ণুদের। কালোবাজারিদের দুষি আমরা। কিন্তু আমি বলব ওই আমাদের দেশের মাথারা, রাষ্ট্রদূতেরা, তার থেকে অনেক বেশি অনিষ্টকারী! কালোবাজারিরা যা করছে, তার পিছনে তবু একটা যুক্তি আছে। ব্যবসা করতে নেমেছে, দু পয়সা লুঠতে চেষ্টা করছে। আর তোরা? শিক্ষিত সভ্য নামধারী অসভ্য অশিক্ষিতরা? একহাতে ভিক্ষের ঝুলি বয়ে বেড়াচ্ছিস, আর অন্য হাতে পয়সার হরির লুঠ দিচ্ছিস। ওদের দেশের ছেঁড়া কাঁথা কুড়িয়ে এনে গায়ে জড়িয়ে বলছিস–দেখ দেখ, আমরা কেমন সেজেছি। আর বলছিস কাকে?না, ওদের কাছেই। বুঝিসনা কত হাস্যাস্পদ হচ্ছিস। অথচ নিজের ঘরে লক্ষ্মীর ঝাঁপি, নিজের ঘরে শাল দোশালা।