শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেলাম। অতটুকু বাচ্চা, তার মাথায় এলোও তো প্রকৃত ঘটনাটা! ঠিক তাই বুঝলে বউমা, অবিকল তাই। ওই ভাবেই মুনিঋষিরা আকাশে উঠতেন, পাতালে ঢুকতেন। তবু তো এ যুগে মায়ের পেটের মধ্যেকার শিশুর সাধ্যি নেই বাইরের জগতের কিছু শোনে কি দেখে। কিন্তু প্রাচীনকালে?
সারদাপ্রসাদ একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসে, প্রাচীনকালে ততদূর পর্যন্তও এগিয়েছে মানুষ। তোমার গিয়ে অভিমন্যুই তার সাক্ষী। কিন্তু সাহেবদের দেশে হোক দিকি এখন ওই ঘটনা? ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। সবাই বলবে-বিজ্ঞানের কী শক্তি! অথচ এমন কপাল আমাদের, কেউ একবার নিজেদের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখবে না। মহাভারতখানা একবার সাহেবদের নাকের সামনে তুলে ধরে বলে উঠতে পারবে না, কীসের বড়াই করছ তোমরা জাদু, এই দেখো। বিদ্যে থাকে তো পড়ে দেখো। বুঝতে পারবে কিছুই নতুন করোনি তোমার।
বলতে বলতে কণ্ঠস্বর উদাত্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদের, চোখ ঝকঝক করে। নিজের একহাতের তালুতে অপর হাতে একটা ঘুসি মেরে বলে, আসল কথা কী জানো বউমা, আমাদের দেশের কারও কোনও বিষয় খেয়াল নেই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও চমকে ওঠে না, উলটে আবার হাসে। তবে এই আমি বলে রাখলাম, এ হাসি আমাদের ঘুচবে একদিন। ওই সাহেবরাই যখন একদিন স্বীকার করবে–আমাদের যা কিছু বিদ্যে সবই তোমাদের ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া বাপু, সংস্কৃত শাস্ত্রের যত কিছু প্রাচীন পুঁথি সেগুলি আমাদের হাতেই এসে গিয়েছিল, তার থেকেই আমাদের এত লপচপানি, তখন আমাদের বাছাধনরা বলবেন, তাই তো, তাই তো, সত্যিই তো! এই যে দেখছি হুবহু সব মিলে যাচ্ছে।
মধ্যাহ্ন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলের রং সোনালি আলো সমস্ত পরিবেশটাকেই যেন সোনালি করে দিয়ে যায়।
আধাপাগল একটা প্রৌঢ় ব্যক্তিকে ঘিরে বসে থাকে কতকগুলো অবোধ বালক আর একটা সংসার-অভিজ্ঞ মলিনবসনা বিধবা।
সারদাপ্রসাদের কথাগুলো তারা ঠিকমতো বুঝতে পারে কিনা কে জানে, কিন্তু সারদাপ্রসাদকে তারা বোঝে। সেই বোঝার মধ্যে এক অপরিসীম কৌতূহল।
এতকাল ধরে তো এই দৃষ্টিরই প্রতীক্ষা করে এসেছে সারদাপ্রসাদ।
এই ভয়ংকর বিস্ময়কর তথ্যটা জেনে ফেলে আবিষ্কারককে তারা মুগ্ধদৃষ্টির প্রদীপ জ্বেলে পুজো করবে না?
সারদাপ্রসাদের কণ্ঠ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে আসে, সারদাপ্রসাদ একটির পর একটি কাহিনী বলে চলে, আর তার ব্যাখ্যা শোনায়।
ওর সেই রাশি রাশি কাগজের ভূপ নিজে হাতে বিসর্জন দিয়েছে ও, কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী হয়েছে? কোন কথাটা হারিয়ে গেছে?
সারদাপ্রসাদের মনের পৃষ্ঠায় আগাগোড়াই ছাপা হয়ে মুদ্রিত নেই?
ছাপাখানায় ছাপা হয়ে সারদাপ্রসাদের এই অমূল্য গবেষণা লোকলোচনে আসতে পেল না বলে আর আক্ষেপ নেই সারদাপ্রসাদের, নেই জগতের ওপর কোনও ক্ষোভ, অভিমান। এই প্রায়-অরণ্য প্রকৃতির কোলে, এই গাছতলায় বসে নিজেকে তার প্রাচীনকালের শিষ্য পরিবেষ্টিত মুনিঋষির মতো লাগে।
সারদাপ্রসাদ অতএব মুনিঋষির দিব্য জ্ঞানটাও পায় যেন। তাই সেই গভীর গম্ভীর গলায় বলে, এত জ্ঞান-বিজ্ঞান, এত যন্ত্র-শক্তি কী করে হারিয়ে ফেলল ভারতবর্ষ তা বুঝতে পারছ? শুধু শক্তির অহংকারে নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করে। লঙ্কাকাণ্ডের পর ত্রেতাযুগ ধ্বংস হল, কুরুক্ষেত্রের পর দ্বাপর। তবু এই অভাগা কলিযুগের চৈতন্য নেই। নিজেকে ধ্বংস করে, সব উন্নতি সমুদ্রের জলে খতম করে আবার গুহার মানুষ হয়ে গিয়ে তবেই যেন ওর ছুটি। হবে, হচ্ছে, এই হিপিরাই তার সূচনা।
শ্রোতাদের কথা বুঝি আর মনে থাকে না সারদাপ্রসাদের, যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা কয়, তবে আর তোদর বড়াই কীসের? বিধাতার নিয়মেই চলছিস তোরা। যেমন দিনের পরে রাত, তেমনি আলোর পরেই অন্ধকার, নিজেদের সৃষ্টি নিজেরাই ধ্বংস করে ফের কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালাবে মানুষ, এও তো সেই প্রাচীনকালের মুনিঋষিরা লিখে রেখেই গেছে।