ওরা হি হি করে হেসে ছুটে পালায় আর চেঁচায়, পাগলা মাস্টার, পাগলা মাস্টার!
ব্যঙ্গ করে নয়, ভালবেসেই।
ওরা যে ওদের ভাইটারদের মতো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না রাখতে পেলেও মনের মধ্যে যোগসূত্র রেখেছে, সেটাই প্রকাশ করে।
পাগলা মাস্টার ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে আজ কোন গল্প বলবে।হনুমানের ল্যাজের আগুনে লঙ্কা পোড়ানোর গল্প অথবা গন্ধমাদন পর্বত বয়ে আনার গল্প, কাঠবেড়ালির সমুদ্র বন্ধনের গল্প এইগুলোয় ওদের মহোৎসব, হেসে কুটিকুটি হয়, ঠেলাঠেলি করে মাটির চাপড়া মাথায় তুলে হনুমান সাজে, কিন্তু সারদাপ্রসাদ যেন মহাভারতের গল্প বলতেই বেশি উৎসাহী। সারদাপ্রসাদ সেকাল আর একালের তুলনা করে একালকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দিতে চায়।
মেয়েরা বিশেষ আসে না, শুধু
মাঝে মাঝে একটি মহিলা শ্রোতা এসে বসে, সারদাপ্রসাদ তটস্থ হয়, সারদাপ্রসাদ কোঁচার কাপড় দিয়ে গাছতলাটা ঝেড়ে ধুলো ওড়ায়।
যে আসে সে অবশ্য গল্প শোনার উদ্দেশ্যে আসে না, আসে সারদাপ্রসাদের জন্যে খাবার নিয়ে। হয়তো নিতান্তই তুচ্ছ সেই খাবার, তবু যে আনে তার হৃদয়ের স্পর্শে সেই তুচ্ছতেই পরমের স্বাদ লাগে।
ওই মলিনবসনা গ্রাম্য বিধবার মুখে রানির মহিমা দেখতে পায় সারদাপ্রসাদ।
যে আসে সে একা আসে না, সঙ্গে তার ছেলে দুটোও আসে। বড়টা কোনও কোনওদিন বলে, জানো দাদু, তোমার বলা রামচন্দরের গপপোটা আমাদের ইস্কুলের বইয়ে আছে।
সারদাপ্রসাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, সেই তিন মাইল রাস্তা ভেঙে ইস্কুল যেতে হয় ভাই, আবার কেন এই দু-কোশ রাস্তা ভেঙে এতদূর আসিস?
মায়ের সঙ্গে আসব না, হিঃ! ছেলেটা সারদার উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে বলে, বেটা ছেলের বুঝি হাঁটলে কষ্ট হতে আছে? মা?
মা ঘোমটার অন্তরাল থেকে মৃদু হেসে বলে, না।
সারদাপ্রসাদ বলে, তুমিই বা কেন প্রায় প্রায় এত কষ্ট করে আমো বউমা? আমিই বরং গিয়ে খেয়ে আসব।
অটল নামের ছেলেটা হেসে উঠে বলে, মা বুঝি নল চালিয়ে তোমায় বলে পাঠাবে আজ কলাবড়া করেছি, আজ সরুচাকলি করেছি! তুমি জানবে কী করে?
সারদাপ্রসাদ বলে, তা এতসব করতেই বা বসো কেন বউমা? তোমার শরীর খারাপ—
অটল বলে, মা বলে, সারাদিন কী করব?
হয়তো সত্যিই তাই, শ্যামাপ্রসাদের হঠাৎ মৃত্যু শ্যামাপ্রসাদের চিরবন্দিনী স্ত্রীকে ভয়ানক একটা মুক্তির শূন্যতা দিয়ে গেছে।
আর তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা।
তাই সে কলার বড়া তালের পিঠের উপচার দিয়ে দুক্রোশ পথ ভেঙে আসে তার চিরদিনের অদেখা খুড়শ্বশুরের কাছে।
ননদ রেগে বলে, শ্যামা মরে তোমার বড্ড পাখা উঠেছে বউ! বলি সাতজন্মের অচেনা খুড়শ্বশুরের জন্যে এত ভক্তি উথলে উঠেছে কেন? বুড়ো নয় হাবড়া নয়, জোয়ান মদ্দ, তার কাছে তোমার যাওয়ার দরকার?
বউ না-রাম না-গঙ্গা কিছুই করে না, অথচ যায়।
ননদ বলে, মুখের ঘোমটাটা ফেলে গলগল করে গপপো হয় বোধ হয় শ্বশুরের সঙ্গে?
বউ বলে, কুচ্ছিত কথা বলে ভগবানের দেওয়া মুখটা নষ্ট কোরো না ঠাকুরঝি।
ঠাকুরঝি এই সদুপদেশ বাণীতে আরও জ্বলে ওঠে। বলে, শ্যামা মরে তোর পা-ই শুধু লম্বা হয়নি বউ, মুখও খুব লম্বা হয়েছে।…ওরে শ্যামা রে, ওপর থেকে দেখ তোর বউয়ের আসপদ্দা। সাতচড়ে যে রা কাড়ত না, সে এখন চোটপাট করছে।
চোটপাট আমি কিছুই করিনি ঠাকুরঝিবলে বউ দুটো ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে।
ননদের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, তাই পিছু পিছু গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে পারে না, পিছনে দাঁড়িয়ে আঙুল মক্কায়। আর চেঁচিয়ে বলে, বলে যা, তবে তুই বলে যা, যাস কেন সেখানে? যাস কেন?
.
কেন যায় সে কথা ননদের কাছে বলে না শ্যামার বউ, বলে আসল জায়গায়। কিন্তু মুখের কাপড় ফেলে কথা তো আর বলে না সত্যি। ছেলেদের মাধ্যমে কথা।
অটল বলে, দাদু, মা বলছে, মৌটুংরিতে তোমার রাজ্যপাট পড়ে, তুমি কেন এখানে পাঁচজনের দয়ায় পড়ে থাকবে?
সারদাপ্রসাদ হেসে হেসে বলে, তোর মাকে বল ভাই, তোর দাদুর এখানেও রাজ্যপাট। রাজা আমি হবই ভাবলে কে তার রাজ্যপাট কাড়তে পারে?
মা বলছে তুমি ওখানে গিয়ে আমাদের দেখাশোনা করবে, আমাদের মানুষ করার ভার নেবে।
দূর দূর! সারদা হেসে ওঠে, তোদের দাদু নিজে তো একটা অমনিষ্যি, সে আবার মানুষ করবে কী! তোরা যে মা পেয়েছিস তাতে তোদের মানুষ হওয়া আটকায় কে?
মা বলছে তোমার বিষয়-আশয় তোমাকে ভোগ করতে না দিয়ে নিজেরা ভোগ করছি, মহাপাপ হচ্ছে আমাদের।
সারদা এ কথায় উষ্ণ হয়েছে।
অতএব সারদা মাধ্যম ছেড়েছে।
সরাসরিই বলেছে, এ কথাটি তো তোমার মতন কথা হল না বউমা! আমার বিষয়-আশয় আমার নাতিরা ভোগ করবে না তো কে করবে শুনি? আমি তো একটা বাউণ্ডুলে পাগল ছাগল, আমি ওসবের মর্ম বুঝি? এ আমি বেশ আছি, খুব ভাল আছি। পাঁচজনের ভালবাসায় খাওয়া থাকাটা চলে যাচ্ছে, এদের নিয়ে আনন্দে আছি।
ছেলেটা আবার মাতৃশিক্ষামতো বলে, মা বলছে, তোমার তো একটা মানসম্মান আছে, বরাবর অন্য লোকে তোমায় খাওয়াবে কেন?
খাওয়াবে কেন?
সারদাপ্রসাদ হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, বলে কিনা খাওয়াবে কেন! আরে বাবা ঘরের ঠাকুরটিকে খাওয়ায় কেন লোকে? পোষা কুকুরটাকে খাওয়ায় কেন? না খাওয়ালে আর কে খাওয়াবে, এই ভেবেই খাওয়ায়। সে খাওয়ায় ঠাকুরও লজ্জা পায় না, কুকুরও লজ্জা পায় না। তবে? তা ছাড়া এই ছেলে, বুঝলে বউমা, ভারী বুদ্ধিমান। এককথায় বুঝে ফেলে। এটা ঠিক নয়, ওটা ভুল বলছ বলে খোঁচ তোলে না। বোঝেও সব। তা তোমার অটলও খুব বোঝে। সেদিন বলছিলাম, সেকালে এই ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা শরীরকে সবরকম সওয়াবার জন্যে গ্রীষ্মকালে আগুন জ্বেলে, শীতকালে একগলা জলে ডুবে, আর বর্ষাকালে খোলা আকাশের নীচে বসে তপস্যা করতেন–ছেলেটা ফটু করে বলে উঠল,ওইসব শুনে শুনে সাহেবরা সব বিদ্যে শিখে নিয়েছে, না দাদু? আমাদের ইস্কুলের মাস্টার মশাই বলেছেন, সায়েবরা যাদের চাঁদে পাঠিয়েছিল তাদেরও ওই রকম করে ঠাণ্ডা গরম, না খেয়ে থাকে, সবকিছু সইয়ে নিয়েছিল।