তার মানে মৌটুংরি গ্রাম থেকে অধিক দূর যায়নি সারদাপ্রসাদ।
তার মানে যে জিনিসগুলোর সন্ধান করছিল সারদাপ্রসাদ, সেগুলো খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেছে। অনেক পথ হাঁটতে হয়নি।
অথবা হয়তো ওই সারল্য, সততা, বিশ্বাস ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য দুষ্প্রাপ্য জিনিসগুলো নিজের কাছেই ছিল সারদাপ্রসাদের, ও মনে করল খুঁজে পেয়েছি।
যদিও একটা বড় হাতুড়ির ঘায়ে ওর ওই দুষ্প্রাপ্য জিনিসের সিন্দুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কে জানে কখন যেন সেই ভাঙা টুকরোগুলোই জোড়া লেগে লেগে আবার আস্ত হয়ে উঠেছে।
হয়তো তেঁতুল পাতার ঝিরিঝিরি, হয়তো ওই নাম-না-জানা নদীটায় বালি চিকচিকে ঝিরিঝিরি জল, হয়তো ওই শাল জঙ্গলের সোঁদা সোঁদা গন্ধ–এরা ভাঙা-জোড়ার কারিগর।
বারেবারে খালি হয়ে যাওয়া ভাঁড়ার বারেবারে পূর্ণ করে তোলার অনাহত লীলায় যে চিররহস্যময়ী, তার একান্ত সন্নিকটে এসে বসতে পারলে ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ আবার কোন ফাঁকে ভরাট হয়ে ওঠে।
অথবা সবাই হয়ে ওঠে না, শুধু সারদাপ্রসাদের মতো বোধহীন মানুষগুলোই। নিজে বোধহীন বলেই হয়তো সারদাপ্রসাদের সঙ্গীগুলোও ততোধিক বোধহীন।
ওরা তাই সারদাপ্রসাদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সারদাপ্রসাদকে দেখলেই মহোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, পাগলা মাস্টারমশাই আসছে, পাগলা মাস্টারমশাই।
মাস্টারমশাই আখ্যা পেল কেন সারদাপ্রসাদ, তা সে নিজে জানে না।
ওই মালকোঁচা মেরে ছোট ছোট ধুতির টুকরো পরা খালি গা ছেলেগুলোকে তোত কোনওদিনই বই শেলেট নিয়ে পড়াতে বসায়নি সারদাপ্রসাদ। ওদের সঙ্গে যোগসূত্র শুধু গল্পবলায় আর শোনায়। সেটা অবশ্য শোনায় সারদা খুব সমাদরে।
যদিও ছেলেগুলো নিতান্তই বালক বলে শুধু খেয়ে খেলিয়ে বেড়াবার ছাড়পত্র পায় না, এদের মধ্যে অনেককেই ছোট ছোট টোকা মাথায় দিয়ে গোরু চরাতে হয়। বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে খেতবাড়িতে গিয়ে উঞ্ছবৃত্তির কাজগুলো করতে হয়, অথবা মজুরানী মায়েদের সঙ্গে সঙ্গে জোগাড়ের কাজে হাত পাকাতে হয়। তবু ফাঁকে ফাঁকে ছুটে আসে ওরা এই শাখা-প্রশাখা ছড়ানো প্রকাণ্ড ছাতিম গাছটার ছাতার মতো ছায়ার নীচে।
নতুন জগতের স্বাদ পাওয়া কৌতূহলী চোখ মেলে মহোৎসাহে বলে, তারপর?
ডাকতে অবশ্য পাগলা মাস্টার বলে না, ওটা উচ্ছ্বাসের ডাক।
সারদা মাঝে মাঝে সচেতন করিয়ে দেয়, মা বাপের কাছে বকুনি খাবি নে তো বাপ? যা বাবা যা, একবার গিয়ে দেখে আয় গোরুগুলো পালিয়ে গেল কিনা। যা বাবা দেখ গে, মা ডাকছে কিনা।
কেউ হয়তো অনিচ্ছা মন্থর গতিতে গুটি গুটি উঠে যায়, কেউ বা হয়তো অগ্রাহ্যভরে বলে, না, ডাকতেছে না, তুমি বলো।
সারদাপ্রসাদ বলতে শুরু করে।
অফুরন্ত গল্পের সঞ্চয় আছে সারদার ভাঁড়ারে, সারদা এইসব চির-পতিত জমিতে তার বীজ ছড়ায়।
গল্প বলে আর তারপর মহোৎসাহে বলে, তা হলে বুঝছিস, সাহেবরা কোনও কিছুই নতুন আনেনি। এই যে নলকূপ দেখতে পাস জঙ্গলে বাংলোর মাঠে, কী যেন বলিস তোরা ওকে? টিপকল তাই না? ওটা সেই হাজার হাজার বছর আগেও ছিল। ভীষ্ম ঠাকুর যখন শরশয্যায় শুয়ে ঠাণ্ডা জল চাইল, অর্জুন তীর মেরে মেরে মাটির ভিতর থেকে জল বার করল মানে কী? কিছু না। ওই টিপল।
আর উড়োজাহাজের গল্প তো বলেইছি সেদিন। এখন যে এতসব অস্তর-শস্তরের বড়াই করে, সব তো মানুষ মারবার কল। মরামানুষ বাঁচাতে পারে কেউ? পারে না। তবে চেষ্টা করছে। আর সেই তখন? হাজার হাজার বছর আগে? হাসতে হাসতে মরামানুষ বাঁচাতে পারত।
বলতে বলতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, শ্রোতাদের গ্রহণের পাত্রটার মাপের হিসেব ভুলে যায়, জোরালো গলায় বলে, লক্ষটা মানুষ মেরে ফেলার থেকে একটা মানুষ বাঁচানো যে অনেক শক্ত তা ভাবে না। শুধু মারামারি। পৃথিবী জুড়ে শুধু মারামারি। ১৪৬
হয়তো এই উত্তেজনার উর্ধলোক থেকে তার শ্রোতাদেরই কেউ তাকে নামিয়ে এনে বলে, সেই অবধি আমরা আর মারামারি করেছি মাস্টারমশাই?
সারদাপ্রসাদ ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসে। বলে, না না, তোরা যে সব সোনার চাঁদ ছেলে।
সোনার চাঁদদের দু-একজন হয়তো পাশের ছেলেদের সঙ্গে চিমটি কাটাকাটি চালাচ্ছিল। তারা হাত ঝেড়ে সামনে এনে অলৌকিক শান্তমুখে বলে, সেই আঙুলকাটার গপপোটা আজ আবার বলো না মাস্টার মশা, ধনু শোনে নাই। ধনুর বাপ সেদিন ওকে হাটে নে গেছিল।
আঙুলকাটার গপপো! অর্থাৎ একলব্যের কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, বরাক্ষসের কাহিনী, জতুগৃহদাহের কাহিনী, এগুলো ওদেরও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। অর্থাৎ সারদা ওদের মগজে ঢুকিয়ে তবে ছেড়েছে।
বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা ওরা ওদের মায়ের কাছে গল্প করে সেইসব কাহিনী হয়তো কতক ভুলে গিয়ে, কতক উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে, তবু ওদের মা বাপেরা সারদাপ্রসাদকে ভক্তিশ্রদ্ধার চোখে দেখে।কথক ঠাকুরদের মতন সুর করে না হোক, সেইসব ঠাকুর দেবতাদের কথাই বলছে মাস্টারমশাই।
.
সারদাপ্রসাদের গল্পের আসরে মেয়ে শ্রোতার অভাব। মেয়েগুলো নিতান্ত শৈশব থেকেই মায়ের কাজে ভিড়ে যায়, পথেঘাটে বিশেষ ঘোরে না। তবু তারাও হঠাৎ কোনখানে টোকা মাথায় সারদাপ্রসাদকে দেখলেই চেঁচিয়ে ওঠে পাগলা মাস্টার লোমোস্কার।
সারদা হাসে, বলে, লোমোস্কার। তা তোরা কেন গপপো শুনতে আসিস না?