নীলাক্ষ মাতাল হলেও ইশারায় ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিয়েছিল, সুনন্দা সে ইশারা গায়েই মাখেনি। হি হি করে হেসে উঠে বলেছিল, দূর দূর, ওরা কি শুনতে পায়? ওরা কালা বোবা অন্ধ।
নীলাক্ষ আর কিছু বলেনি, কারণ তখন নীলাক্ষ চটাতে চায়নি তার স্ত্রীকে।
বাড়ি ফিরেও তোয়াজই করেছে তাকে।
অথচ কোন ফাঁকে সুনন্দা একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে বসে থাকল।
নিঃশঙ্ক নীলাক্ষ লম্বা একটা ঘুমের পর জেগে উঠে হঠাৎ কী ভেবে অভিমানীকে একটু কাছে টানতে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠেছিল, লাফিয়ে পড়েছিল বিছানা থেকে। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল, মা মা, শিগগির একবার এসো এ ঘরে।
হয়তো সরোজাক্ষর আর কোনওদিনই এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া হবে না, হয়তো এই শহরেই কোনও একখানে কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করে নিয়ে আস্তে আস্তে ট্রাম ধরবেন, বাস ধরবেন, ছাতাটা সব সময় হাতে রাখবেন। আর বারেবারে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছবেন।
শৈশব থেকে সরোজা শুধু একটি জিনিসই চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তিনি পাননি। সুন্দরের বদলে অসুন্দরকেই পেয়ে এসেছেন সরোজা, কারণ সরোজাক্ষর মা বাপ জীবনের মানে খুঁজছিলেন রাঢ়ী বারেন্দ্র কুলশীল গোত্র পর্যায়ের মধ্যে। সরোজাক্ষর স্ত্রী জীবনের মানে খুঁজেছিল দেহগত প্রাপ্তির মধ্যে, আর সরোজাক্ষর পুত্র সেই মানেটা খুঁজতে গিয়েছিল ব্যাঙ্কের খাতার মধ্যে।
হয়তো একা সরোজাক্ষরই নয়, সকলেরই এমনি হয়। হয়তো সুন্দরকে চাওয়াটা খুব একটা অসম্ভব চাওয়া, কারণ মানুষরা বড় বেশি নির্বোধ। ওই সুন্দরটাকে তারা নিজে হাতে ধ্বংস করে।
মনে হয় ওরা বুঝি শয়তান, কিন্তু তা নয়। আসলে শুধু ওরা বোধহীন। তাই নিজের হাতে গড়া সভ্যতা নিজের হাতে ধ্বংস করে উল্লাসের হাসি হেসে চিৎকার করে, জিতেছি, জিতেছি!
সরোজাক্ষর ছাত্রদলও তাদের গুরুকে অবমাননা করে মহোল্লাসে ভেবেছিল, জিতেছি, জিতেছি।
দিবাকর নামের সেই মহামূর্খটাও তার স্বর্ণহংসীকে হত্যা করে উল্লাস করেছিল জিতেছি, জিতেছি।
হয়তো বিজয়া একদা যদি একটা হৃতসর্বস্ব রোগজীর্ণ মানুষের দেহটার সেবার অধিকার পায়, সেই দাবিতেই পুলকিত হয়ে ভাববে, জিতেছি, জিতেছি।
বিজয়ার বড় মেয়ে তার স্বামীর কালোবাজারি পয়সায় দামি শাড়ি পরে মোটরগাড়ি চড়ে বেড়াবে আর ভাববে, কী জেতাই জিতেছি।
হয়তো বিজয়ার ছোট ছেলে তার বিপক্ষ পার্টির নেতার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে ভাববে, জিতেছি।
শুধু হয়তো বিজয়ার বড় ছেলে কিছু ভাববে না, শুধু বসে বসে মদ খাবে, আর নেশার ঝোঁকে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবে।আর বিজয়ার ছোট মেয়ে একটা সস্তা স্কুলের মাস্টারি, আর একটা অবাঞ্ছিত শিশুর বোঝা টানতে টানতে ভাববে, জিতলাম না হারলাম?
রুক্ষ শুষ্ক সেই মানুষটা হয়তো ক্রমশ একটা তিক্ততার পুতুল হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কারণ এরা জানত না কোনটা সুন্দর।
আর একদল বোধহীন আছে জগতে। জীবনেও যাদের জ্ঞানচক্ষু খোলে না। জীবনেও যারা লাভ-লোকসানের হিসেব বুঝে উঠতে পারে না। সারদাপ্রসাদ চিরদিনই তাদের দলে। তাই সারদাপ্রসাদ মৌটুংরি গ্রামের দোরে দোরে ঘুরে সহায় সংগ্রহ করে অন্যায় দখলকারী জ্ঞাতি ভাইপোর কবল থেকে নিজের পিতৃভিটে আর সাতপুরুষের বিষয়-আশয় উদ্ধার করবার চেষ্টা না করে চলেই গেল মৌটুংরি ছেড়ে।
অথচ সহায় খুঁজলে পেত।
নির্ঘাত পেত।
কিছু কমিশনের আশা থাকলে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে প্রাণপণ করবার মতো লোকের অভাব ছিল না মৌটুংরি গ্রামে।
সারদাপ্রসাদ সেই সহায়ের পথ না ধরে সামনের পথ ধরল।
কিন্তু সারদাপ্রসাদের সেই পথ কি শেষ হয়েছে? খুঁজে পেয়েছে সে তেমন জায়গা, আজও যেখানে সারল্য আছে, সততা আছে, বিশ্বাস আছে?
তা কে জানে পেয়েছে কিনা খুঁজে, তবে পথচলা থামিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে বটে তাকে একটা জায়গায়। যার সামনে দিয়ে ঝিরিঝিরি একটা নাম-না-জানা নদী বয়ে যাচ্ছে, আর চোখ তুললে আকাশের কোলে কোলে ছোট্ট ছোট্ট টিবি টিবি পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
সারদাপ্রসাদের বসবার জায়গাটা অবশ্য খুব একটা আদর্শ নয়। গাছতলাকে কে আর কবে আদর্শ আশ্রয় বলে? কিন্তু সারদাপ্রসাদই বা কবে লোকে কাকে কী বলে তার ধার ধেরেছে?
ওই গাছতলাটাই তো রাজসিংহাসন লাগছে তার। অন্তত তার মুখ দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে। চোখে তার উৎসাহের উদ্দীপনা, মুখে তার আনন্দের দ্যুতি। তার মসৃণ ললাটে নির্মল সুখের ছাপ। ওর সিংহাসনটা যে নিতান্তই ধূলি-ধূসরিত একটা গাছতলা, ওর পৃষ্ঠপটে যে নিতান্তই একটা মাটির কুটির, সেটা ওর মনেও পড়ছে না।
ওই মাটির ঘরটার গায়ে যে অদ্ভুত সুন্দর করে আলপনা আঁকা আছে, ওই গাছের গোড়াটা যে কাঁকর কাঁকর লালচে মাটির প্রলেপে অভিনব হয়ে উঠেছে, আর ওই কুঁড়েটার পাশ দিয়ে যে পায়েচলা পথটা ঘন চুলের মধ্যেকার সরু সিঁথির মতো যেতে যেতে কোনও একটা জঙ্গলে যেন হারিয়ে গিয়েছে, এইটাই ওর কাছে পরম সম্পদ।
কিন্তু মৌটুংরি গ্রামের ধারেকাছেই তো এ সব ছিল। দেহাতি প্রতিবেশিনীদের দেখাদেখি রান্নাঘরের মেটে দেয়ালে আলপনা আঁকত শ্যামাপ্রসাদের বউ। যা দেখে শ্যামাপ্রসাদের বিধবা দিদি বলত, সাঁওতাল হয়ে গেলি নাকি বউ? তোর ধরনধারণ পছন্দ-অপছন্দ সবই যেন সাঁওতালদের মতো।