সেই নির্লজ্জ খেলাটা এল মৃত্যুর বেশে।
এল সেই রাত্রি শেষ হবার আগেই। যে সকালে যাবার কথা সরোজাক্ষর। কিন্তু সে মৃত্যু রাজার মতো পরম সমারোহে এল না, এল চোরের মতো চুপিচুপি-মৃত্যুর এই তস্করের রূপটা ঘৃণ্য কুৎসিত অশুচি। এই অশুচির সামনে শোকের পবিত্রতা মাথা হেঁট করে দাঁড়ায়, শোকের স্তব্ধতা আতঙ্কে বিদীর্ণ হয়।
এই তস্কর এসে উঁকি মারল সরোজাক্ষর সংসারে। চুরি করে নিয়ে গেল সংসারের এক পরম মূল্যবানকে, আর যেন সেই নিয়ে যাওয়ার সুত্রে ক্রুর হাসি হেসে বলে গেল, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকলেই হয় না সরোজা, শুধু শান্তিপ্রিয় হলেই হয় না। সে শান্তিরক্ষার দায়িত্বও গ্রহণ করতে হয়। না হলে এই রকমই হয়। তোমার সংসারের সব সৌন্দর্যের সবুজ কোন ফাঁকে বিষে নীল হয়ে আছে, তুমি তাকিয়েও দেখোনি, তুমি শুধু নিজেকে ভদ্র আর সুন্দর করে রাখবার সাধনায় নিজেকে ঘিরে দুর্গ রচনা করে তার মধ্যে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছ।
তবে এখন দ্যাখো।
দ্যাখো তোমার দুর্গপ্রাচীরের ওপারে কত বিষ জমছিল। হয়তো তুমি ওই যন্ত্রণাকাতর আত্মাটাকে তোমার স্নেহের স্পর্শ দিয়ে কিছুটা স্নিগ্ধ করতে পারতে, হয়তো ওই নিরুপায় অভিমানকে তোমার ছত্রতলে আশ্রয় দিয়ে, তাকে একটু সুস্থ রাখতে পারতে। হয়তো তোমার আশ্বাস তাকে পায়ের তলায় মাটি দিতে পারত, কারণ সে তোমাকে শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত, ভক্তি করত। কিন্তু তুমি মহিমায় উদাসীনতায় কোনও কিছুর দিকে তাকিয়ে দেখোনি।
দেখো এখন কী দুর্নিবার লজ্জা তোমার, কী দুঃসহ পরাজয়।
আর কেউ বলে যায়নি
ওই মৃত্যুনীল মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এ ভাবনাটা নিজেই ভাবছিলেন সরোজাক্ষ।
আমি ওকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, স্নেহের সঙ্গে, সমাদরের সঙ্গে, তারপর আমি ওকে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্তত ও তাই ভেবে গেল। ধিক্কার দিয়ে গেল আমার নির্মমতাকে, আমার নির্লিপ্ততাকে।
অথচ চিরদিন আত্মহত্যার সংকল্প ঘোষণা করে এসেছেন বিজয়া। যে কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঠাণ্ডা লড়াইয়ে স্বামীকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন গলায় দড়ি দেব বলে।
সেই ঘোষণায় অদ্ভুত এক নিরুপায়তার রজ্জুতে সরোজাক্ষরই দমবন্ধ হয়ে এসেছে, সরোজাক্ষ পরাভূত হয়েছেন।
কিন্তু সেই বিজয়া দীনভাবেই না পরাভব স্বীকার করে বসলেন!
বিজয়া সরোজাক্ষর কাছে আছড়ে এসে পড়ে বললেন, আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।
সেই ভয়ানক মুহূর্তে বিজয়ার তো তাঁর সেই হাতের মুঠোর অস্ত্রটার কথা মনে পড়ল না। সেটাকে কাজে লাগালেই তো জিতে যেতে পারতেন বিজয়া, জব্দ করে ফেলতে পারতেন তাঁর চিরদিনের প্রতিপক্ষকে।
কিন্তু তা করেননি বিজয়া।
বিজয়া হার মেনেছেন।
বিজয়া বলেছেন, আমায় ফেলে চলে যেও না।
মরবার বদলে হারলেন বিজয়া।
তা মরার কথা তো এ বাড়ির ছোট মেয়েটারও ছিল। মরাটাই তো ছিল ওর কাছে সবচেয়ে সহজ সমাধান। কিন্তু ও সেই সহজের পথে যায়নি।
ও সমস্যার জটিলতার জালে নিজেকে জড়িয়েছে, অপর সবাইকে জড়িয়েছে।
অথচ যার মরবার কোনও কথা ছিল না, যার নামের কাছাকাছি মৃত্যু শব্দটাকে কেউ কোনওদিন ভাবতেই পারেনি, সেই মানুষটা অম্লান বদনে একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে মরে গেল।
বিগত সন্ধ্যাতেও সুনন্দা জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মুখে তুলির কারুকার্য করে, ওর বরের সঙ্গে কার যেন একটা দামি মোটরগাড়ি চেপে বেড়িয়ে এসেছে।
বেশ কিছুদিন অবশ্য যাচ্ছিল না ওই প্রমোদ ভ্রমণে, জরির শাড়ি গায়ে জড়াচ্ছিল না, খুব সাদাসিধে সাজ করে ঘরের মধ্যে পড়ে থেকে বই পড়ছিল, ছবি আঁকছিল।
কোনও কোনও দিন হয়তো একা চলে যাচ্ছিল মায়ের কাছে।
মায়ের রান্নাঘরের দরজায় ধুলোয় বসে পড়ে বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না এখান থেকে পালিয়ে যাই অনেক অনেক দূরে?
বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না বেঁচে থাকার মানেটা কী?
মা বলেছে, হয় না আবার? রাতদিনই তো মনে হচ্ছে কোথাও ছুটে পালাই–অহরহই মনে হচ্ছে। এমন দুর্গতি করে বেঁচে থাকার থেকে মরণ ভাল।
বলেছে আর সঙ্গে সঙ্গে খসখস করে বড়ির ডাল বেটেছে, মিহি মিহি করে মোচা কুটেছে, আমতেলে মশলার গুঁড়ো মেখেছে তরিবৎ করে।
সুনন্দা মৃদু হেসে উঠে এসেছে।
একদিন মা বলেছিল, একটা মাত্তর সন্তান, সেটাকে দিয়ে দিলি বোর্ডিঙে, মন হু হু করবে এ আর আশ্চয্যি কী?
সুনন্দা বলেছিল,তুমি ওকে নাও তো বোর্ডিং থেকে নিয়ে আসি, তোমায় দিয়ে যাই।
মা বলেছিল, বালাই ষাট! নিতে যাব কেন? তোর জিনিস তোর বুকভরা হয়ে থাক। তবে যদি আমার কাছে রাখতে চাস
সুনন্দা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, নাঃ যেমন আছে থাক।
কিন্তু কাল সুনন্দা ওর মার বাড়ি যায়নি।
কাল জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বরের সঙ্গে পার্টিতে নাচতে গিয়েছিল। যে নাচের দৌলতে ওর বরের দৌলত বেড়ে যাওয়ার কথা।
সেই মিনতিই করেছিল ওর বর, পায়ে হাতে ধরে বলেছিল, টাকা না থাকলে বেঁচে থাকবার কোনও মানেই নেই সুনন্দা!
নাচের পর সুনন্দা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, আর নীলাক্ষ একখানে বসে বসে গ্লাসের পর গ্লাস খালি করেছিল। দাঁড়াতে পারছিল না, টলছিল।
তারপর সুনন্দাও ফিরে এল প্রায় টলতে টলতে, আর খুব হাসতে হাসতে। কেমন করে যে এক রাঘববোয়ালকে ঘায়েল করে নীলাক্ষর বেঁচে থাকার মানে জোগাড় করবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ফেলেছে, রসিয়ে রসিয়ে তার গল্প করেছিল সারাক্ষণ গাড়িতে।