তাই সে ওই জোরালো রোদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, না থাক, এত বেলায় আর স্নান টান করব না।
অতএব হাতে মুখে জল দিয়েই খেতে বসেছিল সারদাপ্রসাদ। আর সেই সাজিয়ে দেওয়া অন্নব্যঞ্জনে কোনও এক অন্তরালবর্তিনীর শ্রদ্ধা-ভক্তির স্পর্শ পেয়েছিল যেন।
থাকবে না, চলে যাবে।
এতে এত প্রীত হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ যে, ভিতরে গিয়ে বলেছিল, পোস্তর বড়া-টড়া দুখানা করে দাও না। আর যদি ওবেলার জন্যে মাছ থাকে তো না হয় তার থেকে
শ্যামাপ্রসাদের বউ বলেছিল,থাক তোমার আর বুদ্ধি দিতে আসতে হবে না। বাড়ির মানুষ বাড়িতে এসেছেন, দুটো যত্নের ভাত পাবেন না? শ্বশুর যে কেমন বস্তু তা তো চক্ষে দেখিনি, কাকাকে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে পায়ের ধুলো নিই।
থাক, ইচ্ছেময়ীর আর অত ইচ্ছেয় কাজ নেই। শ্যামাপ্রসাদ সন্দেহের গলায় বলেছিল,দেখলে কখন?
বাঃ, সামনেই তো বসে ছিলেন দালানে। এই জানলা থেকে দেখতে পাওয়া যায় না?
থাকবে না।
চলে যাবে।
এই মন্ত্রের জোরে এত সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে পেরেছিল শ্যামাপ্রসাদ। নচেৎ ওই জানলা দিয়ে দেখা নিয়েই লেগে যেত ধুন্ধুমার।
পড়ন্তবেলাতেই বিদায় নিল সারদাপ্রসাদ।
শ্যামাপ্রসাদের দিদি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কাকাকে বিদায় দিতে গিয়ে অভিযোগ করল, এক বেলার জন্যে শুধু মায়া বাড়াতে এলে কাকা! এতকাল পরে সেই যখন এলেই, দুটো দিন অন্তত থাকলে হত। আত্মজন একটু খবরই পেল না। কারুর সঙ্গে দেখা হল না।
সারদাপ্রসাদ সেই তেঁতুলপাতার ঝিরিঝিরিনির দিকে চোখ রেখেই মৃদু হেসে বলল,দেখা হলেও যা, না হলেও তা। আমায় আর কে চেনে?
নাই বা চিনল। নতুন ঠাকুরদার নামেই চিনত।
সেকালের কেউ তো আর বেঁচে নেই।
আছে, কেউ কেউ আছে– শ্যামাপ্রসাদ সাবধানে বলে, নাম করলে চিনতে পারবার লোকও আছে কিছু কিছু।
সাবধানে না বললে?
আগ্রহের অভিনয়টা যদি বেশি জোরালো হয়ে যায় তো লোকটার মন ঘুরে যেতে পারে। তার থেকে ওই সাবধানতাটুকু ভাল।
আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। সারদাপ্রসাদ মনে মনে বলে, তবু যেতে হবে। এইটাই হচ্ছে। আসল কথা।
এবেলা আর গোরুর গাড়ির সুবিধে নেই, দ্রুতপায়ে হেঁটেই যাচ্ছিল সারদাপ্রসাদ। যাচ্ছিল আদিবাসীদের গ্রামের দিকে। ওই ছোট ছোট মাটির কুটিরগুলি দূর থেকে বড় সুন্দর লাগছে।
ওখানে যেতে হবে।
হয়তো এখনও সরলতা নামের বস্তুটা ওখানেই পাওয়া যেতে পারে। হয়তো ওখানেই বাকি জীবনটা কেটে যেতে পারে, শুধু গাছের পাতার ঝিরঝিরির দিকে তাকিয়ে।
প্রকৃতির ওই সবুজের ভাণ্ডার বিষে নীল হয়ে যায়নি, সে তার চির সম্ভার নিয়ে চিরকাল অপেক্ষা করে আছে, থাকবে! বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষ যদি কখনও আবার ফিরে তাকিয়ে দেখে।
অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পর হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ পেয়ে ফিরে তাকাল সারদাপ্রসাদ। দাদু! দাদু! বলে কে কাকে ডাকছে?
সকালের সেই জল এনে দেওয়া ছেলেটা। হাতে তার একটা কাঁচা শালপাতায় মোড়া খাবারের পুঁটলি। সাধ্যের অতিরিক্ত ছুটে ছুটে এসেছে বেচারা। তাই কথা বলতে দেরি লাগে। হাঁপাতে থাকে।
সারদাপ্রসাদ সস্নেহে বলে, কী রে?
ছেলেটা কথা বলার ক্ষমতা পেয়ে বলে, দাদু, মা বলল, তুমি তো রাত্তিরে থাকলে না, তোমার রাত্তিরের খাবার।
সারদাপ্রসাদ মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে বলে, আমি যে তো দাদু হই, এ কথা কে বললে রে?
মা! মা বলল, তোমার বাড়িঘর সব নিজে নিয়ে বাবা তোমায় তাড়িয়ে দিল, থাকতে দিল না।
সারদা মৃদু ভর্ৎসনার গলায় বলে,ছিঃ ও কথা বলতে নেই। আমি পাগলাছাগলা মানুষ, কোনওখানে কি স্থির হয়ে বসতে পারব? ঘুরে ঘুরে বেড়াব। ইস, কত ছুটে এসেছিস তুই।
আসব না, হি! মা বলল না? মা গুরুজন না?
তাই তো, সত্যিই তো।
সারদাপ্রসাদ আস্তে ওর মাথায় একটা হাত রাখে। বলে, বেঁচে থাকো দাদু, সুখে থাকো। কিন্তু এ কত খাবার ভাই, বিরাট ভারী মনে হচ্ছে। তুমি কিছু খাও।
ধ্যেৎ ছেলেটা হেসে ওঠে, তোমার জন্যে আনলাম।নাভু পরোটা আর ভোলাচচ্চড়ি আছে, খেয়ে কিন্তু। আর শোনো, মা বলেছে তোমায় পেন্নাম জানিয়েছে।
সারদাপ্রসাদ সহসা অন্যদিকে তাকায়। সারদাপ্রসাদের কোনওখানে একটু বসে পড়তে ইচ্ছে করে। সারদাপ্রসাদ একটুক্ষণ পরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, তোমার মাকে আমার আশীর্বাদ দিলাম ভাই, বোলো। আর বোলো খাবারটা পেয়ে বেঁচে গেলাম। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল রাত্তিরটা উপোসেই কাটাতে হবে।
দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে সারদাপ্রসাদ। পিছন দিকে আর তাকায় না। তবু অনুভব করে, ছেলেটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
সারদপ্রসাদ অনুভব করে, একটি আধময়লা শাড়িপরা নেহাত সাধারণ গ্রামের মেয়ে ওর পিছনে কোথাও যেন খোলা দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যার কোনও অন্যায়ের প্রতিকারের ক্ষমতা নেই, তবু সে ন্যায়-অন্যায় সত্য-অসত্যের অঙ্ক কষে বেদনা অনুভব করে।
সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সারদাপ্রসাদ।
.
যাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ ছিল। অমোঘ অলঙ্ঘ্য অনিবার্যকে স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত ভবিষ্যৎ চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে, গভীর একটি ত্যাগের জন্য মনকে প্রস্তুত করে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন সরোজাক্ষ, কিন্তু সেই অমোঘ অনিবার্যই যেন নতুন এক নির্লজ্জ খেলায় ব্যঙ্গের হাসি হেসে সবকিছু ভূমিসাৎ করে দিয়ে গেল, মূল্যহীন করে দিয়ে গেল সরোজাক্ষর ত্যাগের গভীরতাকে, দুঃসাহসের শক্তিকে।