অথচ–
হ্যাঁ, অথচ সরোজাক্ষ কর্মক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি উঠে এসে প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর ওই দীর্ঘকালের বিপত্নীক ভগ্নীপতিটিকেই। উঠেই বাঁ দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, কী সারদা, কী হচ্ছে? নতুন কোনও আবিষ্কার হল নাকি আজ?
সারদাপ্রসাদ সামনে পিছনে পাশে কোলে নতুন পুরনো ছেঁড়া ময়লা বই কাগজের বস্তা নিয়ে বসে থাকে চৌকিতে, সাড়া পেয়ে চোখ তোলে, অথবা চোখ না তুলেই বলে, আবিষ্কার কি দাদা, এ তো পড়েই আছে। চন্দ্ৰসূর্যের মতো সত্যি। আমরাই কেবল চোখ থাকতে অন্ধ। আমি শুধু সেই দৃষ্টিটা খুলে দিতে চাইছি–
লোকের জ্ঞানদৃষ্টি খুলে দিতে চাইছে সারদাপ্রসাদ; অর্থাৎ বিরাট এক গবেষণা পুস্তক লিখছে সে।
সারদাপ্রসাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হল–আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রাচীন যোগশক্তি। আধুনিক বিজ্ঞান যা দিয়েছে, অথবা নিত্য নতুন চেহারায় দিয়ে চলেছে, সেসব যে প্রাচীনকালের যোগী-ঋষিদের কাছে ছেলেখেলা মাত্র ছিল, হাজার হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষই যে বিজ্ঞানের শেষ কথা বলে গেছে, এই সত্যটি প্রমাণ করবার জন্যে জীবন পাত করে চলেছে সারদাপ্রসাদ। সারাজীবন ধরে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সে, তত্ত্ব অনুধাবন করছে এবং তুলনা ও উদাহরণ লিপিবদ্ধ করছে। সব গোছানো হয়ে গেলেই থিসিসটি লিখে ফেলার কাজে হাত দেবে।
সরোজাক্ষ মাঝে মাঝে খোঁজ নেন, কী সারদা, তোমার থিসিসের কতদূর?
সারদাপ্রসাদ মহোৎসাহে বলে, এই তো দাদা, এইবার আরম্ভ করব। এদিক ওদিক আর সামান্য একটু গোছানো বাকি।
সরোজাক্ষ হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে চলে যান, হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে বলেন, আরম্ভটা করেই ফেলল। হাত না দিলে এগোবে না।
না দাদা, সারদাপ্রসাদ আত্মস্থের গলায় বলে, সবদিক থেকে গুছিয়ে না নিয়ে হাত দেওয়াটা ঠিক নয়। গোছটা হয়ে গেলেই হেসে ওঠে সারদাপ্রসাদ, ধরব, আর মারব।
সারদাপ্রসাদের পৈতৃক সম্পত্তির নিজ অংশ থেকে মাসে মাসে কিছু ভাড়া পায়, জ্ঞাতি ভাইপোরা করুণাপরবশ হয়েই হোক, বা চক্ষুলজ্জার বশেই হোক, পাঠিয়েই দেয়, মেরে নেয় না। সেই টাকায় সারদাপ্রসাদ রাজ্যের পুরনো পুরনো বই কেনে, আর দিস্তে দিস্তে কাগজ কেনে। সে সব কাগজের পারিপাট্য কম নয়, আলাদা আলাদা অধ্যায় হিসেবে পাঞ্চকরে, দড়ি বেঁধে, মলাট লাগিয়ে, দস্তুরমতো ব্যবস্থা করে রাখে সে। এমনকী পর পর পৃষ্ঠাসংখ্যা পর্যন্ত লিখে রাখে, যাতে পরে না এলোমেলো হয়ে যায়। এখন শুধু ধরা আর মারাটাই বাকি।
বিজয়া এক-আধ সময় তীক্ষ্ণ হুল ফোঁটানো গলায় বলেন, সময়কালে ওই ধরা আর মারার অভাবেই আমরা আজ পড়ে মার খাচ্ছি।
কমলাক্ষ যখন ছুটিতে আসে, মাঝে মাঝেই বলে, পিসেমশাইয়ের ওই ধরা আর মারাটা যদি আমাদের জীবকালে হত, তা হলে দেখে যেতে পারতাম।
ময়ূরাক্ষী কদাচ আসে।
তবু কড়া হুল বিঁধিয়ে বলে,আরে বাবা, আমি যা বলছি সারকথা, ওই থিসিসটি একটি আবরণমাত্র। বউ নেই, অথচ শ্বশুরবাড়িতে শেকড় গেড়ে বসে আছি–এই লজ্জাটি ঢাকবার ছল। মনে হচ্ছে থিসিস উনি কোনওকালেই লিখবেন না। দেখে নিও তোমরা। আমি বলছি–পাগলও নয় ছাগলও নয়, স্রেফ ফন্দিবাজ ধূর্ত।
আগে ময়ূরাক্ষী এত আক্রোশের গলা তুলত না, এখন তোলে। ওর বর ওর বাপ-ভাইকে বোকা বুদ্ধ বলে বড় ঠাট্টা করে বলে লজ্জায় অপমানে আক্রোশ জন্মে গেছে। নইলে পিসেমশাই যে ওদের সংসারে বাড়তি মাল, অনাবশ্যক জঞ্জাল, পরগাছা, এসব কথা ওর মাথায় আসত না। এখন আসে। বরের ভাবেই ভাবিত ময়ুরাক্ষী, বরের চোখেই জগৎ দেখে।
মীনাক্ষীর অবশ্য সে প্রশ্ন নেই, কারণ মীনাক্ষীর এখনও বর হয়নি। কিন্তু নিজেই সে দুনিয়া দেখতে শিখে ফেলেছে; তাই তার চোখেও পিসেমশাইয়ের এই নিশ্চিন্ত জীবনটি অসহ্য। তাই মীনাক্ষী বলে, মরে মনিষ্যি হব, ঘরজামাই হয়ে জন্ম নেব! বাবাঃ কার জামাই কে পুষছে।
বলে, তবে সরোজাক্ষর সামনে নয়।
সরোজাক্ষ যে বকেন তা নয়, সরোজাক্ষ কেমন অদ্ভুত একটা ধিক্কার দেন। এ ধরনের কথার আভাসমাত্র শুনলেই একবার চোখ তুলে বলেন, এসব ছোট কথা তোমাদের মাথায় আসছে কী করে। বলো তো?
অতএব বাবার সামনে নয়।
অতএব সরোজাক্ষ সিঁড়িতে উঠেই প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর বাড়ির সেই অবান্তর লোকটাকেই। কী সারদা, কাগজপত্র আছে তো? কী সারদা, বিকেলে একবার বেরোও না? শরীর ভাল থাকবে কী করে?–সারদা, একটা বাংলা টাইপরাইটার থাকলে তোমার বেশ সুবিধে হত, তাই না?
ওরা শুনতে পেলে ঘরে বসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, তা দাও না, তুমিই একটা কিনে দাও। এত যখন ভালবাসা!বলে, শরীর ভাল থাকার সুরও তো কিছু দেখি না। আহারটি যা দেখা যায়… বলে, ওঃ কাগজের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, তার মানে এসে যাবে দু-চার দিস্তে।
তবে যাকে প্রশ্ন করা হয়, সে বোঝে এগুলো প্রশ্নের জন্যে নয় কথার জন্যে। কথা বলবার একটা উপলক্ষ। তাই সে আত্মস্থর গলায় বলে, আপনিও যেমন দাদা, আবার টাইপ মেশিন! ভগবান পাঁচ-পাঁচটা আঙুল তবে দিয়েছে কেন?..বলে, শরীর? এ শরীর হচ্ছে দধীচির হাড়ে তৈরি বুঝলেন? বজ্র, বজ্র!.বলে, কাগজ থাকবে না? ফুরুতে দিই নাকি? কমতে নামতেই এনে মজুত করি না?
ব্যস ওই পর্যন্তই।
সরোজাক্ষ হয়তো ততক্ষণে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।
আজ কিন্তু সরোজাক্ষ কথা বলতে ভুলে গেলেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ভয়ানক একটা ক্লান্তি অনুভব করছেন, তাই কখনও যা না করেছেন তাই করলেন। হাতমুখ না ধুয়ে পোশাক না ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। সরোজাক্ষর পক্ষে এটা একটা লক্ষণীয় অনিয়ম।