এই মানসিক উদ্বেগের অবস্থায় কে পারে কাকা কাকা করে গড়িয়ে পড়তে? অন্তত শ্যামাপ্রসাদ পারবে না। এই রুক্ষ মাটির বক্ষ থেকে ক্ষুধার অন্ন আহরণ করতে হয় তাকে।
শ্যামাপ্রসাদ যদি একবার তার জ্ঞাতিকাকাকে তার নিজস্ব অধিকারের জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়, রক্ষে আছে?
তাই সারদাপ্রসাদ যখন নেহাতই স্মৃতির মন্থন করে জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা কোনদিকে যেন আমরা থাকতাম? সেই বড় একটা টানা বৈঠকখানায় বাবা বসতেন, আরও সব কারা আসত, দাবা খেলত–
তখন শ্যামাপ্রসাদ একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলে, সেই টানা বৈঠকখানা? হায় অদৃষ্ট! সে তো কবে ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। ভিটেবাড়ি না দেখলে যা হয়। তুমি তো শুনতে পাই এখেনে ইস্কুলের পড়া সাঙ্গ করেই কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছ, তারপর বড়লোকের বাড়ি বে করে ঘরজামাই থেকেছ, এযাবৎ আর এ মুখো হওনি। মানুষকে যেমন ভাত জল দিতে হয়, ভিটেবাড়িকেও তেমনি ভাত-জল দিতে হয়। তা সে কথা আর মানলে কবে? এখনও যে তোমার সেই বাড়ি-ঘরের চেহারা মনে আছে, এইটাই অবাক কথা!
সারদাপ্রসাদ তার প্রায় সমবয়েসী ভাইপোর এই অবাকে নিজের সেই মনে থাকার লজ্জায় মরমে মরে। বাস্তবিক তো, মনে থাকাটা উচিত হয়নি তার। প্রশ্ন করাটা আরও গর্হিত হয়েছে।
ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমনি হঠাৎ স্মরণে এল। সত্যিই তো, থাকবে কেন? যাবেই তো পড়ে।
শ্যামাপ্রসাদের বুক থেকে পাহাড় নামে।
তারপর ভাবে, ভাগ্যিস খামারবাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নিয়েছি। নচেৎ চোখে পড়ে যেত।
তবে পাড়ায় নয় নয় করেও কুটিল বুড়ো দু-চারটে আছে তো? তারা একা পেলেই ঠিক ওর কানে তুলবে। কে জানে কতদিন থাকবার মতলবে এসেছে? জিনিসপত্তর যখন কিছু আনেনি, বেশিদিন থাকবে না বলেই মনে হয়। কিন্তু একেবারে এত শূন্য হয়ে কি লোকে একবেলার জন্যেও আসে?
ভগবান জানে রাস্তায় বাক্স সুটকেস খোয়া গিয়েছে কিনা–মুখের চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। যাই হোক, চোখে চোখে রাখতে হবে।
পাড়ার লোকের সঙ্গে একবারও একা মিশতে দেওয়া হবে না। যে কদিন থাকে, একটু ইয়ে হয়ে থাকলেই তবে আদরযত্ন নয়। আদরযত্ন পেলে আর রক্ষে থাকবে না। এসো লক্ষ্মী, যাও বালাই। আমি তো বাবা এই সার বুঝি।
তা ক-অক্ষর গোমাংস গাঁইয়াটি এবং তার সংসার যা বুঝল তাই করল।
বাড়ির ভিতরের যে মহিলাটি ছেলের হাত দিয়ে জলের সঙ্গে জলচৌকি পাঠিয়ে দিয়েছিল, ভিতরে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাকে চাপা তর্জনে শাসিয়ে আসে, তোমায় অত সর্দারি করতে কে বলেছিল, অ্যাঁ, কে বলেছিল? খবরদার! বেশি লাই দিতে যেতে হবে না। মানে মানে বিদেয় করবার চেষ্টা করতে হবে।
তা সেই চেষ্টাটা কি করতে হয়েছিল সারদাপ্রসাদের জন্যে?
নাঃ।
সারদাপ্রসাদ নিজেই বিদায় নিয়েছে।
সারদাপ্রসাদ তার ভাইপোর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছে, এসেছি যখন, তখন দুদিন থেকে যেতে বলছ? তা থাকতে পারলে তো আমারও ভাল লাগত, কিন্তু থাকার উপায় কোথা?
শ্যামাপ্রসাদের মুখ থেকে উদ্বেগের পাথর সরে গিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ এরপর তার কাকার এতদিন পরে দেশে এসে দুটো দিন থাকতে না পারার জন্যে অনেকখানি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করেছিল।
সারদাপ্রসাদ চুপ করে তাকিয়ে থেকেছিল সামনের তেঁতুল গাছটার দিকে।
যেখানে ঝিরিঝিরি পাতার এক পরম সৌন্দর্যের খেলা চলেছে অবিরাম ভাবে।
প্রকৃতির ঘরে এমন কত ঐশ্বর্য, কত সৌন্দর্যের সঞ্চয়! যাদের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
অথচ সারদাপ্রসাদ কোনওদিন এই বিনামূল্যে বিকোনো অফুরন্ত ঐশ্বর্যের দিকে ফিরে তাকায়নি। সারদাপ্রসাদ দশ ফুট বাই বারো ফুট একখানা ঘরের মধ্যে নিজেকে কবরিত করে ফেলে–একটা মুর্শের স্বর্গের স্বপ্ন দেখেছে বসে বসে।
প্রকৃতির এই অফুরন্ত ঐশ্বর্যের রাজ্যে কোথাও একটুকরো জায়গা কি জুটবে না সারদাপ্রসাদের? শ্যামাপ্রসাদের উদ্বেগ হয়ে এই মৌটুংরি গ্রামে পড়ে থাকবে সে? নাঃ, থাকবার ইচ্ছে নেই সারদাপ্রসাদের।
আরও তো হাজার হাজার গ্রাম আছে বাংলাদেশে। সবই তো সারদাপ্রসাদের মাতৃভূমি।
তা সেদিন কি সারদাপ্রসাদ স্নান আহার কিছুই না করে বিদায় নিয়েছিল তার সাত পুরুষের ভিটে থেকে?
না না, তাই কি হয়?
শ্যামাপ্রসাদ তাই ছাড়ে কখনও?
স্নান না হোক, আহারটা হয়েছিল বইকী!
স্নানের জন্যেও প্রস্তাব দিয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ। বলেছিল, তোমার কাপড়জামাগুলো পরে স্নান করে এসে ওগুলো মেলে দিয়ে ততক্ষণ না হয় আমার একখানা ধুতিটুতি পরে খাওয়া দাওয়া করো, শুকিয়ে গেলে নিজেরটা পরে নিও। দেরি হবে না, রোদের জোর আছে।
রোদের জোর আছে!
রোদের যে জোর আছে, সে খবর টের পাচ্ছিল বইকী সারদাপ্রসাদ, শরীরে প্রত্যেকটি অণুপরমাণু থেকে টের পাচ্ছিল। দুদিন স্নান হয়নি। স্নানটাই একমাত্র বিলাস ছিল সারদাপ্রসাদের।
যার জন্যে বিজয়া রেগে রেগে বলতেন, জামাই নবাব চৌবাচ্চার সবটুকু জল নিজের গায়ে ঢালছেন, আর যেন কারুর কাজ নেই।
তা বিজয়ার কথা বাড়ির কেউই গায়ে মাখত না, সারদাপ্রসাদও না। কথা গায়ে মাখার অভ্যাসই ছিল না তার।
হঠাৎ কেমন করেই যেন তার অভ্যাসের জগৎটা আমূল পালটে গেল।