সারদাপ্রসাদ সেই অবাক অবাক অসহিষ্ণু গলায় বলে, এখন নয় তোকখন? এই তো আসছি। বাবা, যা ধুলো, গলা শুকিয়ে গেছে। জল দেখি দিকি এক গ্লাস।
তুমি আপনি বাঁচিয়ে এই প্রার্থনা।
মহিলাটি কিন্তু ওই আবেদনেও বিশেষ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন না, সেই ছেলেটার মতোই ভিতরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে কাকে যেন উদ্দেশ করে বলেন,এই এক গ্লাস জল আন তো।
মহিলাটির কণ্ঠে জেলার টান। সেই বিশেষ একটি টান সংবলিত ভঙ্গিতেই তিনি আবার প্রশ্ন করেন, এখনি এলেন তো সঙ্গে জিনিসপত্তর কই?
সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।
ওঃ, তাই ওই বাহুল্য প্রশ্ন।
অন্যখান থেকে এলেই মানুষের সঙ্গে কিছু না কিছু থাকে। নিদেন একটা হাতব্যাগও।
সারদাপ্রসাদের সঙ্গে কিছু নেই।
সারদাপ্রসাদ তার সমস্ত অন্তরটার মতোই শূন্য দুখানা হাত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কেন?
সারদাপ্রসাদের হাত একেবারে শূন্য কেন? কিছু তো থাকবার কথা। সারদাপ্রসাদ তো তার বাকি খাতার বোঝা সরিয়ে নিয়েছিল বিজয়ার ঘর খালি করে দিতে।
সারদাপ্রসাদের সেই আজীবনের ফসল সোনার ধানের বোঝর খানিক অংশ না হয় হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, কিন্তু বাকিগুলো সারদাপ্রসাদ করল কী?
সেগুলো তো আনবে?
না সেগুলো আনেনি।
কিন্তু সেই বোঝা নিয়ে করবেই বা কী সারদাপ্রসাদ? প্রিয়জন যতই প্রাণপ্রিয় হোক, তার মৃতদেহটা কে বয়ে নিয়ে বেড়ায়? তার শেষ সমাপ্তি তো হয় আগুনে, নয় জলে।
সারদাপ্রসাদের ওই প্রাণপ্রিয় খাতাগুলোর তো এখন মৃত্যু ঘটেছে, অতএব তাদের ওই দুটোর কোনও একটায় ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কী করবে?
তারপর এই চির অবহেলিত পিতৃভিটেয় এসে দাঁড়িয়েছে একান্ত প্রিয়জনকে পুড়িয়ে আসা শ্মশানপ্রত্যাগতের মূর্তি নিয়ে।
কিন্তু তেমন মূর্তি কে পছন্দ করে?
ঝকঝকে সুটকেস হাতে মটমটে চেহারার শহুরে আত্মীয় হঠাৎ গ্রামে এসে দাঁড়ালে, জ্ঞাতিরা তাকে সমীহর দৃষ্টিতে দেখে, এমন সর্বস্বান্তের মূর্তিকে আদৌ নয়।
তাই শ্যামাপ্রসাদের দিদি জলের আদেশ দিলেও পিপাসার্তের জন্যে তটস্থ হলেন না। খাতির করে বসতেও বলেন না, বরং উত্তর না পেয়েও আবার প্রশ্নের গামছা ছাঁকা দিয়ে খবরের চুনোপুঁটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
কখনও তো আসতে দেখি না, এতদিনে বুঝি দেশকে মনে পড়ল?
এই আর কি, আসা হয়ে ওঠেনা–সারদাপ্রসাদ অন্যমনস্কের মতো এদিক ওদিক তাকায় কোনও একটা বসবার আসনের প্রত্যাশায়। কোথাও কিছু নেই, শুধু ওই উঁচু দাওয়ায় ওঠবার ইটের কোণ ভাঙা বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িগুলো ছাড়া।
তা সেও তো ধূলিধূসরিত।
সারদাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলে, শ্যামাপ্রসাদ কখন আসবে?
তার আসতে দেরি আছে। কই রে অটল জল আনলি নে?
এতক্ষণে অটল নামধারী একটা একটু বড় ছেলে ঝকঝকে করে মাজা একটা ঘটিতে একঘটি জল নিয়ে আসে, তার সঙ্গে অপর হাতে ঝুলিয়ে আনে একটা জলচৌকি।
শ্যামাপ্রসাদের দিদি অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বলেন,তুই এই ভারীটা বয়ে আনলি? রাখাল কী করছে?
সে তো গোরু ছাড়তে গেছে।
দিনভর গোরু ছাড়ছে? মহিলা বেজার গলায় যেন অনুপস্থিত রাখালের ফাঁকি দেওয়ার সমস্ত দোষটা সারদাপ্রসাদের ঘাড়েই চাপিয়ে বলেন, নিন বসুন কাকা,শ্যামা বাড়িতে থাকতে এলে আপনাকে এত অসুবিধেয় পড়তে হত না।
না না, অসুবিধে কী?
সারদাপ্রসাদ দাওয়ায় উঠে জলচৌকিতে বসে ঘটির সব জলটুকু খেয়ে শেষ করে একটা নিশ্বাস ফেলে গলায় বুকে ছিটিয়ে পড়া জলের ধারা মুছতে থাকে কোঁচার কাপড় তুলে তুলে। ঘটিতে জল খাওয়ার অভ্যাস তো নেই।
শ্যামাপ্রসাদের দিদি মনে মনে বলেন, শহুরে ভূত! চুমুক দিয়ে ঘটিতে জল খাচ্ছে।
মুখে বলেন,তা আপনি হাতমুখ ধোবেন তো?
সারদাপ্রসাদ বোকার মতো গলায় বলে, হাতমুখ? কেন স্নানের সুবিধে হবে না?
ওমা শোনো কথা। চানের আবার অসুবিধে কী? পুকুরে কি জল নেই? তবে আপনার কাপড় গামছা তো দেখছি নে–
শ্যামাপ্রসাদের দিদি বেজারই থাকেন। অনেক মালপত্র নিয়ে এসে-পড়া আত্মীয়ও যেমন ভীতিকর বইকী! হয়তো তদপেক্ষাও। চান করতে উদ্যত হয়েই তো ও প্রথমে চাইবে তেল গামছা, তারপর চাইবে কাপড়।
এ আবার কী মুশকিল! সেই মুশকিলের চিহ্ন ফুটে ওঠে তার মুখে। সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।
সারদাপ্রসাদ যেন তার কোনও এক প্রগতির গতির ভরসায় এসেছে।
তাই সারদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বলে, তবে থাক, তবে থাক, শ্যামাপ্রসাদ এলেই হবে এখন। জিনিসপত্তর আনা হয়নি–মানে হঠাৎ চলে এলাম কিনা–
শ্যামাপ্রসাদের দিদি এই হঠাৎ-এর কারণ নির্ণয় করতে পারেন না। সেই একই ভাবে বলেন, তবে বসুন। শ্যামা আসুক। তবে এভাবে একবস্ত্রে আসা আপনার উচিত হয়নি কাকা!
ভাইঝি আর একবার কাকাকে উপদেশ অমৃত দান করে বলেন, একটা বেলা থাকলেও, মানুষের একখানা ধুতি গামছা লাগে।
ভিতরে ঢুকে যান তিনি, দরজাটি বন্ধ করতে ভোলেন না।
সারদাপ্রসাদ একা বসে থাকেন সেই অদেখা, বা ভুলে যাওয়া ভাইপোর আশাপথ চেয়ে। যেন সেই শ্যামাপ্রসাদই বুঝবে তাকে।
হয়তো বুঝত শ্যামাপ্রসাদ।
যতই হোক রক্তের সম্পর্ক।
কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ তার থেকে অনেক বেশি বোঝে টাকা-পয়সা। সেটা নাকি গায়ের রক্তেরও অধিক।
তাই শ্যামাপ্রসাদ এসেও আহ্লাদে অধীর হয় না কাকাকে দেখে।
কী করেই বা হবে?
সারদাপ্রসাদের বাপের দিকের ভিটের অংশটা শ্যামাপ্রসাদের খামার বাড়ি হয়নি কী? নিজের রান্নাঘরটা পড়ে যাওয়া ইস্তক-সারদাপ্রসাদের দিকের ভাঁড়ার ঘরটায় রান্নার কাজ চালাচ্ছে না? আর শ্যামাপ্রসাদের নিজের পাতকুয়োয় বালি ওঠা ইস্তক, সারদাপ্রসাদের দিকের পাতকুয়োটাই ব্যবহার করছে না কি? তা ছাড়া বাগান পুকুর সবই তো। তবে?