গ্রামের চেহারা এমন দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। সেখানে হয়তো বড়লোকের ভেঙে যাওয়া দালান কোঠাটা দশ-বিশ বছর ধরে ভাঙতে ভাঙতে ভূমিসাৎ হয়, হয়তো গ্রামদেবতার মন্দিরের মাথার হেলে যাওয়া চুড়োটা ধীরে ধীরে আর একটু হেলে, শানবাঁধানো চকচকে নাটমন্দিরটায় অলক্ষ্যে কখন ফাটল ধরতে থাকে, কাকচক্ষু পুকুরটা তিলে তিলে পানায় মজতে থাকে।
আর কী?
বড়জোর কেউ ভিটের সংস্কার সাধন করতে ইটবারকরা দেয়ালের গায়ে ব্যঙ্গহাসির মতো একটু চুন লেপে, হয়তো বা কেউ রান্নাঘরের পড়ে যাওয়া ছাদটার কড়ি বরগা রাবিশ ফেলে দিয়ে দুখানা নতুন করোগেট টিন বসায়। বহু ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো বৃহৎ গাছগুলো ঝড়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া নতুনত্বের কোনও ছাপ নেই এই মৌটুংরির মতো গণ্ডগ্রামে।
রেল স্টেশনের ধারেকাছে যে সব গ্রাম, তাদের অনেক উন্নতি হয়েছে।
সেখানে ছাইকেল রিকশার দেখা মেলে, সেখানে ঘরে ঘরে বাইসাইকেল। তরুণ সমাজের পরনের ধুতি অপসারিত, সেখানে প্যান্টের একাধিপত্য রাজত্ব। সেই প্যান্টের পকেট হাতড়ালে প্রায় প্রত্যেকের পকেটেই একটা করে টর্চ পাওয়া যাবে, মাঝে-মাঝেই কোনও অবস্থাপনের ছাওয়ালের পকেটে ট্রানজিস্টার।
রেল স্টেশনের ধারেকাছের গ্রাম থেকে চট করে দু-একটা স্টেশন পার হয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, মনের মতো জামা জুতো শাড়ি ব্লাউজ কিনতে যাওয়া যায়, হাই-ইস্কুল এবং সরকারি হাসপাতালের সুবিধেও মেলে।
মৌটুংরি রেল স্টেশন থেকে অনেক মাইল দূরে। এখানে সাইকেল রিকশার টুংটাং সুদুর স্বপ্নের ছায়া। নিজের পা আর গোরুর পা, এইমাত্র ভরসা এখানে। তবে মাল বোঝাই গোরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনির কামাই নেই। কতখানি যেন দূর দিয়ে কোন প্রাপ্তসীমার পারের পথে মহাজনদের লরি গাড়ি যায় গ্রামের অন্ন লুঠ করে নিয়ে যেতে, ওই গোরুর গাড়ি কাজে লাগে সেই লুঠের মালগুলো পৌঁছে দিতে।
তেমনি একখানা মালবওয়া গাড়ির ফিরতি খেপের সুযোগ রেল স্টেশন থেকে গ্রামের মধ্যে ঢুকে এসেছে সারদাপ্রসাদ, গাড়োয়ানের সঙ্গে ভাব জমিয়ে।
ওই গাড়োয়ানরা বেশিরভাগই দেহাতি বিহারি, লাহিড়ী বাড়ির ঐতিহ্যের খবরের ধার ধারে না, কাজেই তাদের কাছে হদিস মেলেনি। গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে, জিজ্ঞেস করে করে আর চিনে চিনে এসে দাঁড়িয়েছে লাহিড়ী বাড়ির ভিটের উঠোনে।
তা ভিটেটা না হয় চিনে বার করা গেছে, কিন্তু পাতলা লম্বা শ্যামবর্ণ, আর সুকুমার মুখ এই আধাবয়েসী মানুষটাকে চিনবে কে? কার দায় আছে তাকে চিনে ফেলে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করবার?
পরিচয় দিয়ে তবে চেনাতে হবে।
কিন্তু সেই পরিচয়টাই বা কাকে দিতে বলবে সারদাপ্রসাদ? নিজেই কি সে চেনে কাউকে? তা ছাড়া ধারেকাছে আছেই বা কে?
তবু মনিঅর্ডারের কুপনের স্বাক্ষর স্মরণ করে গলা ঝেড়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে ডাক দেয়, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন?
যদিও ওই উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার ভাইপো, তবু বাবুই বলে সারদাপ্রসাদ।
সারদাপ্রসাদ যদি কিছুদিন আগেও শুধু পিতৃভিটে দেখব বলে বেড়াতে আসত, সারদাপ্রসাদের কণ্ঠে অন্য সুর বাজত।
উল্লাসের সুর, প্রত্যাশার সুর, অকুণ্ঠিতের সুর।
কিন্তু সারদাপ্রসাদ একটা মারখাওয়া পশুর মতো ছুটে চলে এসেছে, আর কোনও জায়গার কথা মনে পড়েনি বলে। আর সারদা এই সামান্য কদিনেই অনেকখানি বয়েস বাড়িয়ে এসেছে। এসেছে পৃথিবী সম্পর্কে যেন অনেকখানি অভিজ্ঞতা নিয়ে।
আগে হলে সারদাপ্রসাদ নিশ্চয়ই ভাবত, এতদিন পরে এলাম আমি, আমায় দেখে আনন্দে দিশেহারা হবে এরা। ভাবত, কী জানি বাবা, ছাড়তে চাইবে কি না।
কিন্তু বয়েস বেড়ে যাওয়া সারদাপ্রসাদ তা ভাবছে না। বরং ভাবছে চিনতে চাইবে তো? জায়গা ছেড়ে দেবে তো?
ওই বাবু ডাকের মধ্যে সেই সংশয়ের দ্বিধা।
বারদুই ডাকের পর, সামনের দালানের একটা ভেজানো দরজা খুলে গেল, একটা ছিটের ইজের পরা ছোট ছেলে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল, কে?
আমাকে তুমি চিনবে না–সারদাপ্রসাদ আর একটু এগিয়ে এল, তুমি শ্যামাপ্রসাদবাবুর ছেলে?
ছেলেটা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, পিসি, দেখো কে এসেছে
এবার দেখা গেল এক মলিনবসনা বিধবা মহিলাকে। চেহারায় বয়েসের থেকে অনেক বেশি জীর্ণতার ছাপ। দরজাটাকে এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় রূঢ় গলায় প্রশ্ন করে, কাকে চান?
সারদাপ্রসাদের বয়েস বেড়েছে, তবু সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারে না এই অকারণ রূঢ়তার অর্থ কী?
এরা যে অপরিচিতকে দেখলেই সন্দেহ করে, আর সন্দেহ করে বলেই প্রথম থেকেই শক্ত হয়, সেটা জানা ছিল না সারদাপ্রসাদের। তাই রূঢ়তায় আরও বিষ হল সে।
আস্তে বলল, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন? মানে আমি তাঁর কাকা, সারদাপ্রসাদ। কলকাতা থেকে এসেছি।
বিধবা মহিলা এবার কিঞ্চিৎ সহজ কণ্ঠে বলেন, ও, বুঝেছি। নতুন ঠাকুরদার ছেলে! আমি শ্যামার দিদি! তা আপনি এখনই এলেন বুঝি?
কণ্ঠস্বর ততটা রুক্ষ না হলেও আনন্দে অধীর নয়। বরং অপ্রসন্নতার আভাস।
সারদাপ্রসাদ এ প্রশ্নে অবাক হয়।
এখনই এলেন, এমন একটা বাহুল্য প্রশ্নের হেতু কী? সারদাপ্রসাদের কি এখানে অন্য আস্তানা আছে যে, সেখানে নেমে ধীরে সুস্থে স্নানাহার সেরে জ্ঞাতি গোত্রের বাড়িতে দেখা করতে এসেছে?