তবু সরোজাক্ষর কুণ্ঠিত ধূসর গলা আর একটা কথা উচ্চারণ না করে পারল না, কিন্তু তোমার ওই সব ঠাকুর-টাকুর
সে ভাবনা আমার।
সরোজাক্ষ দৃষ্টিকে প্রসারিত করলেন।
সরোজাক্ষ তাঁর ভবিষ্যতের ছবির দিকে তাকালেন। যেখানে বুঝি একটুকরো আলোর আয়োজন হচ্ছিল, সেখানে নিয়তির লোমশ কালো হাতের থাবা দেখতে পেলেন। যে থাবা চিরদিনের জন্যে কবলিত করে রেখেছে সরোজাক্ষকে। ওর থেকে মুক্তি নেই সরোজাক্ষর।
অতএব সরোজাক্ষকে এই চিরপরিচিত জায়গাটা ছেড়ে অজানা অপরিচিত কোনও এক পরিবেশে বিজয়াকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাততে হবে।
বিজয়ার এই আবেগ, এই ব্যাকুলতা, এই আত্মনিবেদনের নম্রতা অবশ্যই চিরদিনের নয়, বিজয়া সেই নতুন পরিবেশে আবার সোচ্চার হবেন, বিজয়া হয়তো সেখানে মীনাক্ষীকে নিয়ে বহু মিথ্যার জাল রচনা করতে বসবেন।
সরোজাক্ষ যখন মীনাক্ষী নামের বিপদটাকে মাথায় তুলে নেবার সাহস করছিলেন, ভেবেছিলেন ডাক্তার আর টাকা এই দুটো জিনিস হাতে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্রহীন হয়েও যে কোনও অবস্থাকে আয়ত্তে আনা যায়।
কী ভাববে আশেপাশের লোক!
যা ইচ্ছে।
তবু কেউ এসে সরোজাক্ষর জীবনের জানলায় উঁকি দিতে সাহস করবে না। ভেবেছিলেন তাই। কিন্তু বিজয়া সেই নিশ্চিতার ছবিতে মোটা তুলির একটা কালির পোঁচ বসিয়ে দিলেন। বিজয়া গেলেই সে জানলার কপাট ভেঙে পড়বে, আর বিজয়া বানানো কথার জাল বুনে বুনে তাকে আবৃত করবার হাস্যকর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
এই মুহূর্তে
এত স্পষ্ট আর পরিষ্কার করে কিছু ভাববার ক্ষমতা হয়তো হয়নি সরোজাক্ষর, তবু নিয়তির সেই লোমশ থাবার পিছনে এমনি অনেক ছায়াছবির মিছিল যেন সরোজাকে ব্যঙ্গ কটাক্ষ করে গেল।
তবু সরোজাক্ষ সেই থাবার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করলেন।
বললেন, বেশ চলো! তোমার যদি অসুবিধে না হয়—
অসুবিধে হবে কেন?
কিন্তু অসুবিধেই তো হবার কথা বিজয়ার। বিজয়া কি তাঁর ওই বিগ্রহের সংসারটিকে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁর নতুন সংসারে?
যাঁদের গ্রীষ্ণকালে পাখার বাতাস করে ঘুম শুকিয়ে দিতে হয়, আর শীতকালে গায়ে গরম চাদর টেনে দিতে হয়, যাঁদের ভোরে ঘুম ভাঙাতে হয়, আর রাত্রে ঘুম পাড়াতে হয়, এবং ক্ষণে ক্ষণে ভোগ দিতে হয়, তাঁদের কী ব্যবস্থা হবে সেখানে?
না, সেখানে আর কী করে কী ব্যবস্থা হবে? ওই ঠাকুরের সংসারটিকে বিজয়া পুরোহিত বাড়িতে রেখে যাবেন।
বিবেকের দংশন?
না, তাতেই বা দংশিত হতে যাবেন কেন বিজয়া? উচিতমতো সেবার জন্যে মোটা প্রণামীর ব্যবস্থা করে যাবেন।
সরোজাক্ষ চলে গেলে বিজয়া ওই ছবি আর পুতুলগুলো নিয়ে করবেন কী? শত্রুপক্ষ বিদায় নিলে যুদ্ধের হাতিয়ার কোন কাজে লাগে?
.
গ্রামের নাম মৌটুংরি।
কে জানে কী তার অর্থ, অথবা সেটা কোন কথার অপভ্রংশ। কোন সূত্রে যে কোন নাম গড়ে ওঠে গ্রামের, শহরের, পল্লীর।
হয়তো বা ভাষাটা আদিবাসীর।
কারণ গ্রামটা একটা আদিবাসী পল্লীর গা ঘেঁষা।
গ্রামের কোল দিয়ে বয়ে যাওয়া অজানা নামের ঝিরিঝিরি একটা নদী আছে, ছোট ছোট ঢিবি ঢিবি পাহাড়ের মতো আছে একেবারে গ্রামের কিনারে।
বাংলার গ্রাম হলেও, মাঠে ঘাটে গাছে পালায় যেন বিহারের রুক্ষতার আদল।
এইখানে সারদাপ্রসাদের পিতৃভিটে।
কতদিন আগে ছেড়ে যাওয়া এই গ্রামটার পথে হঠাৎ একদিন সারদাপ্রসাদকে দেখা গেল। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, লাহিড়ী বাড়িটা কোনদিকে।
ঠিকানা অবশ্য জানা আছে সারদাপ্রসাদের। জ্ঞাতিরা মাঝে মাঝে তার ভাগের জমিজমার উপস্বত্বস্বরূপ কিছু পাঠিয়েছে এ যাবৎ।
বিবেকের তাড়নায় পাঠাত না অবশ্যই, পাঠাত বোধ করি পাছে সারদা হঠাৎ কোনদিন এসে হাজির হয়ে নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে বেচে-টেচে দিতে আসে। সেটা বড় ঝামেলা। তার চাইতে মুষ্টিভিক্ষা একটু দিয়ে রাখা ভাল।
তা, তার জন্যে সারদাপ্রসাদের কখনওই কিছু এসে যায়নি। নমাসে ছমাসে যদি কিছু আসত, চট করে বেশ কিছু লেখার সরঞ্জাম কিনে ফেলত। কাগজকালি ব্লটিং পেপার আলপিন, এটা ওটা।
নিজের অন্য প্রয়োজনে?
সে কথা কোনওদিন ভেবে দেখেনি লোকটা।
জামা ছিঁড়ে গেলে অম্লানবদনে ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, কাপড় সেপটিপিন দিয়ে আটকে রেখে পরতেও দ্বিধা করেনি। তবে আশ্চর্য, সরোজাক্ষর মতো অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষেরও কেমন করে যেন ওই ঘাড়ছেঁড়া শার্ট, কিংবা সেপটিপিন আটকানো ধুতি চোখে পড়ে যেত। তবে তেমন অবস্থাটা সহজে হত না, সরোজাক্ষর জামা কাপড় তোয়ালে গেঞ্জির সঙ্গে সারদাপ্রসাদেরও আসবে এই নিয়মটাই সরোজাক্ষর বাবার আমল থেকে বলবৎ ছিল।
যা দেখে বিজয়ার বাপের বাড়ির লোকেরা গালে হাত দিতেন, মেয়ে মরে গেছে, তবু বুড়ো জামাই পুষছে। ধন্যি বাবা!
কিন্তু সে যাক! সে জীবনে তো ইতি পড়ে গেছে।
এ এক নতুন সারদাপ্রসাদ তার পিতৃভিটেয় ফিরে এসেছে, জীবনের আর একটা নতুন অধ্যায়ের পাতা ওলটাতে।
একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে পথটা স্মৃতির পটে ফুটে উঠতে থাকে।
শহরের রাস্তা নিত্য পরিবর্তনশীল।
আজ যেখানে মাঠ, কাল সেখানে বৃহৎ ইমারত, আজ যেটা নিচু ছোট একতলা বাসা, কাল সেটা বিরাট তিনতলা প্রাসাদ। আজ যেখানটা শৌখিন ব্যক্তির বাড়ির সামনের পুষ্পেদ্যান, কাল সেখানটা সারি সারি দোকানঘর।