হ্যাঁ, সরোজাই বললেন।
.
কতকাল পরে, মনে হল যেন কত যুগ পরে মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন সরোজা।
কোনও ভূমিকা করলেন না, শান্তভাবে বললেন, মীনা, তুই তোর জামাকাপড় গুছিয়ে ঠিক করে রাখ, আমার সঙ্গে যাবি।
মীনাক্ষী জানত বাবা চলে যাচ্ছেন, তবু মীনাক্ষী দম আটকানো বুকে নিজের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। মীনাক্ষীর নিশ্চিত ধারণা ছিল, বাবা সব জানেন, তাই বাবা ঘৃণায় চলে যাচ্ছেন। ধারণা ছিল বাবা তাকে একটি কথাও বলে যাবেন না।
যখন দেখল দরজায় বাবা, তখন ভাবল বাবা যে ঘৃণায় ধিক্কারে চলে যাচ্ছেন, সেই কথাটাই জানিয়ে যাবেন বলে এসে দাঁড়িয়েছেন। এস্তে উঠে পড়ে মনকে শক্ত করে বসে রইল। না, কিছুতেই ভেঙে পড়বে না সে। কিছুতেই কেঁদে ফেলবে না।
কিন্তু অচিন্তিত একটা কথা বললেন বাবা।
সহজ সাধারণ গলায়।
যেন মীনাক্ষী নামের সেই অনেকদিন আগের মেয়েটাই বেঁচে আছে। যেন অনেকদিন আগের সেই সরোজাক্ষ মেহগম্ভীর গলায় বলছেন, কাল এই পড়াটা তৈরি করে রেখো, আমি দেখব।
তবে কি বাবা জানেন না?
কিন্তু তা হলে বাবা হঠাৎ মীনাক্ষীকে নিয়ে যেতে চাইবেন কেন? মীনাক্ষী যে আর কলেজে যায় না, সে কথা কি জানেন সরোজাক্ষ?
তা নয়।
এ হচ্ছে মীনাক্ষীর প্রতি দণ্ডাদেশ।
বাবা!
সরোজাক্ষ চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু বলবি?
বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ওই মরার কথাটাই মনে এল মীনাক্ষীর। এতদিন এত রকমের মধ্যেও যে কথাটা কোনওদিন মনে আনেনি, মুখে আসেনি।
আজ সরোজাক্ষর ওই স্বাভাবিক গলার ওই ভয়ংকর অদ্ভুত একটা নির্দেশে, যা মৃত্যুদণ্ডাদেশের মতোই লাগল মীনাক্ষীর, মীনাক্ষী মৃত্যুচিন্তা করল। মীনাক্ষী ভাবল, মরাই উচিত ছিল আমার। এখনও ফুরোয়নি সে সময়।
তাই মীনাক্ষী তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বলে উঠল, বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।
সরোজাক্ষ চলে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। ঘরে এসে সামান্য হেসে বললেন, নিজের মতো করে কোনও কিছু করার অধিকার কারও নেই মীনা, বাঁচবারও না, মরবারও না।
মীনা তবু মাথা হেঁট করে কাতর গলায় বলে, আমায় যেতে আদেশ করবেন না বাবা
সরোজাক্ষ ওর ওই বিশীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। তারপর প্রায় অভ্যাস ছাড়া অন্তরঙ্গ গলায় বলেন, আদেশ বলছ কেন? কী মুশকিল। অনুরোধ করছি। আমি বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি, আমায় কে দেখাশোনা করবে? একজনের তো গেলে ভাল হয়?
সরোজাক্ষ বলছেন,আমায় কে দেখাশোনা করবে? সরোজাক্ষ বলছেন তাঁর জন্যে একজনের গেলে ভাল হয়। সরোজাক্ষকে কি তবে কেউ ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে?
মীনাক্ষী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার চলে যাওয়ার পথের দিকে।
.
ভেবেছিলেন কোথাও কোনও বন্ধন নেই, দেখছে সহস্র বন্ধন। সবচেয়ে বড় বন্ধন বুঝি এই বইয়ের পাহাড়।
এই পাহাড় নিয়ে যাবার কথাও ভাবা যায় না, রেখে যাবার কথাও ভাবা যায় না। সরোজা তবু বিশেষ দরকারি কয়েকটি বেছে আলাদা করছিলেন, খানিকক্ষণ বাছতে বাছতে সহসা চোখে পড়ল ওই বিশেষ দরকারিতেই ছোটখাট একটি পাহাড় হয়ে গেছে। এদের গুছিয়ে তুলে সুটকেসে ভরতে হবে ভেবে ভারী একটা ক্লান্তি বোধ হল, সব সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন, জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কত রাত এখন?
দুটো? আড়াইটে? তিনটে?
কলকাতার রাস্তায় রাত বোঝা শক্ত, তবু গভীরত্বটা বোঝা যাচ্ছে। রাত্রিশেষের আভাসবাহী একটা হিম হিম হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে।
সরোজাক্ষর মুখেচোখে এসে লাগছিল সেই হাওয়া।
সরোজাক্ষ ভাবছিলেন, নিয়তি বলে সত্যিই কেউ আছে কোথাও?
আজ সকালে কি আমি ভেবেছিলাম
পিছনে কীসের একটা শব্দ হল।
ফিরে তাকালেন।
বিজয়া এসে ঘরে ঢুকেছেন।
সরোজাক্ষ শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন, আবার কী?
কিন্তু বিজয়া কী বলে তাঁর শুচিতার গৌরব ভুলে বিছানার উপর এসে বসলেন?
নিজের বিশুদ্ধ শয্যা ছাড়া অন্য কারুর বিছানা তো স্পর্শও করেন না বিজয়া। এত রাতে আবার কোন দরকারে? আরও কী সাংঘাতিক গোপন তথ্য আছে বিজয়ার ভাঁড়ারে? যার জন্যে বিজয়া এতখানি উলটোপালটা কাজ করে বসতে পারেন?
সরোজাক্ষ তাকিয়ে দেখেন।
কিন্তু এ কী গোপন তথ্য ভাঁড়ার থেকে বার করলেন বিজয়া?
অবচেতনের কোন অতলে তলিয়ে ছিল এই তথ্য? বিজয়া নিজেই কি জানতেন?
জানতেন কি, এমন করে অভিসারিকার মতো গভীর রাত্রির মৌন মহিমা বিদীর্ণ করে সরোজা নামের ওই পাষাণমূর্তিটার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে বলতে আসতে হবে তাঁকে, আমায় ফেলে রেখে যেও না তুমি, আমায় নিয়ে চলল।
তুমি আমায় ফেলে রেখে যেও না।
এ কী অলঙঘ্য ভাষা!
বিজয়ার ওই রূঢ় রুক্ষ স্থূল সোচ্চার মনের কোন গভীরে লুকোনো ছিল এ ভাষা?
সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?
সরোজাক্ষ একটা ভয়ংকর দুঃসাহসিক শপথে মীনাক্ষী নামের ওই দুরূহ বিপদকে স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ এই আবেদনের বিপদের সামনে থতমত খেলেন। সরোজা বলতে পারলেন না, ঠিক আছে, চলো৷
সরোজাক্ষ যেন বোবা দেয়ালের কাছে উত্তরের আশ্রয় খুঁজলেন।
সরোজাক্ষ সে আশ্রয় পেলেন না।
সরোজাক্ষ ধূসর গলায় বললেন,তুমি! তুমি কেমন করে যাবে?
বিজয়া মুখ তুললেন।
নিশ্চিত গলায় বললেন, যেমন করে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে যায়।