বিজয়া শুনলেন, বামুন ঠাকুরের মুখে।
তাঁকেই জানিয়েছেন সরোজাক্ষ, সকাল করে ভাত দেবার জন্যে।
বিজয়া এসে ঘরে ঢুকলেন।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন।
বিজয়ার চোখে আগুনের ঝলক।
বিজয়ার মুখে পাথরের কাঠিন্য।
সরোজাক্ষ তবুও হয়তো কিছুই বলতেন না যদি না বিজয়া অমন করে দরজা বন্ধ করে আটকে দাঁড়াতেন।
সরোজাক্ষর হঠাৎ মনে হল, যেন অনেক অনেকগুলো দিন আগের বিজয়াকে দেখছেন। সরোজাক্ষ প্রায় প্রায় তাঁর পড়ার ঘরেই রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত কাটিয়ে ফেলতেন, পড়াশোনা করতে করতে, এবং একান্তভাবে প্রার্থনা করতেন বিজয়া যেন ঘুমিয়ে পড়ে, তিনি বাকি রাতটুকু এই সোফাটাতেই কাটিয়ে দিয়ে বাঁচেন।
কিন্তু প্রার্থনা পূর্ণ হত না।
একঘুম থেকে উঠে নীচের তলায় পড়ার ঘরে নেমে আসত বিজয়া, আর এইভাবে দরজাটা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াত। বিজয়ার চোখে আগুন জ্বলত, বিজয়ার নিশ্বাসে আগুন ঝরত। বিজয়াকে যেন একখানি সুন্দরী পিশাচীর মতো দেখতে লাগত।
বিজয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপ রূঢ় গলায় বলত, তুমি ভেবেছ কী?
সরোজাক্ষ এই মূর্তিকে ভয় করতেন। কারণ সরোজা জানতেন ওর ওপর কথা বলতে গেলে কেলেঙ্কারি করতে পিছপা হবে না ও।
তাই সরোজাক্ষ ফিকে গলায় বলতেন,তুমি ঘুমোওনি এখনও?
ঘুম! বিজয়া কটু গলায় বলতেন, ঘুমোব, একেবারে জন্মের শোধ ঘুমোব, তোমাকে চিরশান্তি দিয়ে যাব। সেই ঘুমের ওষুধটা এনে দিয়ে আমায়। কিন্তু যতক্ষণ না দিচ্ছ–
সরোজা খাতাপত্র গুছিয়ে তুলতে তুলতে তাড়াতাড়ি বলতেন, কী যে যা-তা বলল। এই পড়তে পড়তে কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে
থাক থাক, রোজ রোজ আর একই কৈফিয়ত দিতে এসো না। তোমার বলতে ঘেন্না করে না, আমার শুনতে ঘেন্না করে। আর কত চুনকালি দেবে আমার গালে! বাড়ির ঝি-চাকরটা পর্যন্ত বুঝে ফেলেছে। আমার দাম কী।
নিশ্বাসের তালে তালে বুকটা এমন ওঠাপড়া করত যে, মনে হত ফেটে পড়বে।
বিজয়ার আজকের এই চেহারায় সেই অতীতের ছবি দেখতে পেলেন সরোজা।
শুনতে পেলেন সেই কণ্ঠস্বর।
সংসারের সব দায় আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে চাও, কেমন?
সরোজাক্ষ শান্ত গলায় বলেন, সংসারের দায় তো কোনওদিনই আমি বহন করিনি।
তা জানি। চিরটাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছ। কিন্তু চিরদিন চলেছে বলেই যে চিরকাল চলবে, তার মানে নেই। ভেবেছিলাম বলব না, ভেবেছিলাম এত বড় সর্বনেশে কথাটা বলে হার্টের অসুখের রুগির হার্টটা ফেল করিয়ে বসব? কিন্তু তুমি যখন নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাচ্ছ, তখন তো আর না বলে পারছি না। আমি একলা মেয়েমানুষ কি আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে নার্সিং হোমে ছুটব?
বিজয়ার বুকটা ওঠাপড়া করতে থাকে।
বিজয়ার কণ্ঠে আগুন ঝরে।
বিজয়া যে চাপা তীব্র গলায় আরও কত কথা কয়ে যাচ্ছেন তা শুনতে পান না। সরোজা যেন হঠাৎ একটা বিরাট গহ্বর দেখতে পেয়েছেন, যে গহ্বরটা তাঁর নিজে ত্রুটির, নিজের অক্ষমতার।
বিজয়া বলে চলেছেন, আমি পারি না, আমার দ্বারা হয় না বলে তোমরা দিব্যি গা বাঁচিয়ে চলতে পারো, যত দায় এই মেয়েমানুষের। কিন্তু কেন? বলতে পারো কেন? মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আসা ছেলেবউয়ের সঙ্গে ডেকে কথা বলতে হবে আমাকেই, আইবুড়ো মেয়ের কেলেঙ্কারি ঢেকে বেড়াতে হবে আমাকেই
সরোজাক্ষ হঠাৎ কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করো।
চুপ করব?
হ্যাঁ, চুপ করবে। আর একটি কথা উচ্চারণ করবে না।
বিজয়া অনেক রকম কথা ভেবে এসেছিলেন, অনেক যুক্তিতর্কের ভাষা মনে মনে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। বিজয়া হঠাৎ সমস্ত আত্মসম্মান বিজর্সন দিয়ে কেঁদে ফেলেন।
অপমানের কান্না, দুঃখের কান্না, অসহায়তার কান্না।
সেই উচ্ছ্বসিত কান্নার গলায় বলেন,বেশ, চুপ করছি। চিরকালের জন্যেই চুপ করব। শুধু বলে যাও, ওই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করব?
আগুনের জায়গায় জল।
সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করলেন, ওকে আমি নিয়ে যাব।
ওকে আমি নিয়ে যাব।
ওকে আমি নিয়ে যাব।
এ কী অদ্ভুত ভাষা।
সরোজাক্ষ কি বিজয়ার সঙ্গে ব্যঙ্গের খেলায় নামলেন?
না কি না বুঝেসুঝে কী একটা বলে বসলেন?
অগাধ বিস্ময়ে বিজয়ার চোখের জল মুহূর্তে শুকিয়ে গেল।
বিজয়া যেন যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলেন,ওকে তুমি নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। ওকে প্রস্তুত করে রেখো।
সরোজাক্ষ তাঁর রায় উচ্চারণ করে থেমে গেলেন। বিজয়া জানেন, আর একটি কথাও বলবেন না উনি।
কিন্তু এ কী ঘোষণা?
এ কি বিজয়াকে শাস্তি দেওয়া?
বিজয়ার আবার কান্না উথলে ওঠে, কষ্টে কান্না থামিয়ে বলেন, তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে করবে কী? রাখবে কোথায়? আমায় শান্তি দেবার জন্যে
বহুদিন পরে বিজয়ার নাম ধরে ডাকলেন সরোজাক্ষ।
বললেন, তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে নয় বিজয়া, শাস্তিই যদি বলল, তত বোধহয় নিজেকেই দেবার জন্যে।
বিজয়া কি ওই সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন? তাই বিজয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
বিজয়া আস্তে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন।
প্রকৃতিবিরুদ্ধ নম্র রুদ্ধ গলায় বললেন, কিন্তু ওকে আমি এ কথা বলব কী করে? ও ভাববে বুঝি ওর প্রতি ঘেন্নায় রাগে তুমি নিজের উপর শোধ নিচ্ছ।
সরোজা বলেন,ঠিক আছে, তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলব।