এদের দিয়েই দেশ ছাওয়া।
সরোজাক্ষর প্রশ্ন করতে হয় তাই করেন। তোমার আর ভাই নেই?
আছে স্যার। একটি ছোট ভাই আছে, ক্লাস টেন-এ উঠল এবার। ভাবছি ওকে আর হায়ার এডুকেশনে দেব না। কোনও টেকনিক্যাল লাইনে
সরোজাক্ষর ক্লান্তি আসছিল।
সরোজাক্ষর ভয় করছিল–এরপরই হয়তো বয়স্থা আইবুড়ো বোনের কথা তুলবে এবং বিয়ের বাজার নিয়ে দার্শনিক মন্তব্য করবে।
সরোজাক্ষ তাই বলেন, সেটাই ভাল। এখন যাচ্ছিলে কোথায়?
এই এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে নাকি ওঁর ভাইপোর বিশেষ চেনা-জানা আছে। দেখি যদি বলে কয়ে দেশের স্কুলে একটা মাস্টারি পেয়েছিলাম, মানে তারাই ধরাধরি করছিল, বুঝলেন? মারও খুব ইচ্ছে ছিল যাতে দেশেই থাকা হয়। মাইনে-টাইনেও আজকাল আগের মতো পুওর নয়, সবই ঠিক, কিন্তু কী জানেন স্যার, লাইনটা বড় ইয়ে। মানে মানসম্ভ্রম বলে কিছু থাকে না। স্কুল মাস্টার শব্দটাই যেন হতশ্রদ্ধার। নয় কি না বলুন?
উত্তরের আশায় সরোজাক্ষর মুখের দিকে তাকায় শিখরেন্দু।
কিন্তু কী উত্তর দেবেন সরোজাক্ষ?
নয়, এ কথা বলতে পারবেন?
সরোজাক্ষ অতএব বলেন, সর্বত্র নয়।
এবার ছেলেটি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, নয় কি বলছেন স্যার? সর্বত্র। সর্বত্রই এক অবস্থা। এখন আর গুরুমশাই-এর বেতের ভয়ে ছাত্ররা তটস্থ নয়। ছাত্ৰমশাইদের বেতের ভয়ে গুরুমশাইরাই আশঙ্কিত। সেই যে ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সেই দেশেতে বেড়াল পালায় নেংটি ইঁদুর দেখে মনে হচ্ছে সেই মজার দেশটাতেই বাস করছি আমরা। নচেৎ আপনার মতো মানুষের–ছেলেটার করুদ্ধ হয়ে আসে, শুনেছি তো ব্যাপার! কাগজে বেরিয়েছিল! আপনার মতো মানুষকে যে এভাবে
সরোজাক্ষ মৃদু দৃঢ় গলায় বলেন, যাক ও সব কথা। অনেক পুরনো হয়ে গেছে।
শিখরের কিন্তু এ ইশারায় চোখ ফোটে না, সে উদ্দীপ্ত গলায় বলে, আপনি স্যার মহানুভব মানুষ, অপমান গায়ে মাখেন না, কিন্তু শুনে আমাদের যা মনের অবস্থা হয়েছিল! আর কিছুই নয় স্যার, সবই পার্টি পলিটিক্স! ওই স্টুডেন্টদের মধ্যেই যা চাঁই এক-একখানি আছে স্যার! বছর বছর ইচ্ছে করে ফেল করে করে কলেজের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে থাকে, আর অন্য সব ছেলেকে বিষাক্ত করে তোলে।
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ইচ্ছে করে ফেল করে?
হাসছেন স্যার? আছো কোথায় আপনি? যা অবস্থা হয়েছে আজকাল শিক্ষা বিভাগের। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি। কোথাও বাদ নেই। শুধু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিই নয়, সর্বত্র! আমার এক পিসতুতো দাদা–
সরোজাক্ষর বুঝতে দেরি হয় না। শিখরেন্দু নামের এই ছেলেটির কোনও কথাটাই নিজস্ব চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, সবই ওই পিসতুতো দাদা আর মাসতুতো জামাইবাবুর ব্যাপার। সব উত্তেজনাই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ওর যদি এখনি একটা মনের মতন চাকরি পায়। যে চাকরির আয় থেকে অন্তত শহরে একটু বাসা করা যায়, এবং একটি বিয়ে করে ফেলে সোনার সংসার রচনা করা যায়।
সময়ে উপার্জনআর সময়ে বিয়ে, এটাই বোধ করি যুগ-যন্ত্রণার ওষুধ। ওইটার অভাবেই ওরা আগুন জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে।
পিসতুতো দাদার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে ইচ্ছে হল না সরোজাক্ষর, তাই বললেন, হ্যাঁ, চারদিকেই তো ওই পাটি-পলিটিক্স।
সেই কথাই তো বলছি স্যার শিখরেন্দু মহোৎসাহে বলে, আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার পিছনেও তাই। নইলে–
সরোজাক্ষ দৃঢ়স্বরে বলেন, না! ওর মধ্যে অন্য কিছু নেই। সম্পূর্ণ আমার নিজের দোষ। আমি ওদের প্রতি সম্মান রেখে ব্যবহার করিনি, ওরা শুধু তার পালটা জবাব দিয়েছে। আমার আরও ভদ্র হওয়া উচিত ছিল, আরও সহিষ্ণু হওয়া উচিত ছিল।
শিখরে এবার যেন একটু থতমত খায়।
আস্তে বলে, কাগজে কিন্তু
কাগজের কথা বাদ দাও। ওরা সব কিছুতেই লাগাতে ভালবাসে। আচ্ছা
সরোজাক্ষ বিদায়ের ইঙ্গিত করলেন।
নাছোড়বান্দা ছেলেটা তবু স্রিয়মাণ গলায় বলে, কিন্তু একটা কথা শুনে বড় দুঃখ পেলাম স্যার, আপনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন–
কলেজ ছাড়িনি–সরোজাক্ষ স্থির গলায় বলেন, ওই কলেজটা ছেড়েছি।
সেই তো, সেই কথাই তো বলছি–ওখানে আপনি নেই, ভাবতেই পারা যায় না–
সরোজাক্ষ এবার হাসেন, তাতে তোমার আর আক্ষেপকীসের? তুমি তো আর আবার ওখানে ভর্তি হতে আসছ না?
শিখরেন্দুও এবার হাসে।
তা না হোক। তবু মানে এখনকার স্টুডেন্টদের জন্যেই
ওখানে ছাড়াও তো স্টুডেন্ট আছে। তাদের নিয়েই কাজ করা যাবে। কাজ করারই চেষ্টা করব এবার। এতদিনের ফাঁকির প্রায়শ্চিত্ত করতে চেষ্টা করব।
ফাঁকি! আপনি!
শিখরেন্দু প্রায় জিভটা বার করে জিভ কাটে।
আপনি দিয়েছেন ফাঁকি! সেই কথা বিশ্বাস করব? লোকে বুঝি এই কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে? ছি ছি! যুগে যুগে এই হয় স্যার! মহতের পিছনেই ষড়যন্ত্র চলে।
দুঃখে ভেঙে পড়ে শিখরেন্দু।
সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে দেখেন না। বলেন, আচ্ছা, আশা করছি শিগগিরই কাজ পেয়ে যাবে।
চলে যান আর না তাকিয়ে।
ভাবেন, ফাঁকি দিইনি তো কী?
তুমিও তো আমার হাত দিয়েই পার হয়েছ।
.
যে খবর সযত্নে গোপন করেছিলেন বিজয়া, সেই খবর নিয়েই এসে ফেটে পড়লেন, যখন শুনলেন সরোজাক্ষ সত্যিই চলে যাচ্ছেন এবং একেবারে একাই যাচ্ছেন।
শেষ পর্যন্ত আশা ছিল তাঁর, সরোজাক্ষর দ্বারা অতখানি হয়ে উঠবেনা। একা বাক্স-বিছানা নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন জীবিকার সন্ধানে, এ অসম্ভব। কিন্তু বিজয়ার আশাভঙ্গ হল, সরোজা ঘোষণা করেছেন, কাল নটার গাড়িতে বেরোতে হবে আমায়।