সরোজাক্ষ বড় বেশি পীড়াবোধ করলেন, যখন দেখলেন, ওই শীতলপাটি আর বেলের পানাশব্দ দুটি একখানা শীর্ণ মুখের রেখায় রেখায় যেন অসহায়তার আর অপমানের গভীর বেদনা ফুটিয়ে তুলল, আর সারা গাড়িতে তুলল কৌতুকের হাসির ঢেউ।
যখন দেখলেন, ওই ঢেউ থেকে নব প্রেরণা লাভ করে নতুন উদ্যমে গলায় রঙিন রুমালবাঁধা ছোকরা আবার বলে উঠল, সত্যি, কেন ঝুটমুট আসেন দাদু? আমাদের দিদিমা বুঝি মানা করেন না? এবং জনতার হাসি আরও উদ্দাম হয়ে উঠল।
আশ্চর্য। এর মধ্যেকার নির্মমতা কি কারও চোখেই পড়ছে না? সরোজাক্ষ যেন অবাকই হলেন। সরোজাক্ষ চঞ্চল হলেন, সরোজা জানলার বাইরে মুখ রাখলেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই হাস্যমুখর কামরার মধ্যে বোধ করি সহানুভূতির মুখ দেখতে না পেয়েই ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন, এখুনি নেমে যাব ভাই, বেশিক্ষণ তোমাদের অসুবিধে ঘটাব না।
আহাহা, অসুবিধে কী? চুকচুক ছোকরা হাঁটুদুটোকে একবার টুইস্ট নাচের ভঙ্গিতে মোড় খাইয়ে বলে ওঠে, বরং বলুন উপকার। মাঝে মাঝে খোঁচাটা বিশেষ দরকার দাদু, তাতে বেচাল হবার ভয় থাকে না। এই তিন ভুবনে এত যে বেচাল দেখছেন, সবই তো ওই যথাসময়ে আর যথাস্থানে খোঁচাটুকুর অভাবে।
এবার হাসির বাঁধ ভাঙল।
সরোজাক্ষ সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নেমে পড়লেন বাস থেকে।
আশ্চর্য, মানুষ জাতটা কী নির্লজ্জ! কী নির্মম!
অথবা মানুষ জাতটা নয়, ওই জনতা নামক জাতটা।
৬. মাথার উপর চড়া রোদ
ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন সরোজা।
কোন দিক লক্ষ্য করে, তা বোঝা গেল না। হয়তো নিজেও তিনি জানেন না সেটা। অথচ মাথার উপর চড়া রোদ। গায়ে সেই আগুনের হলকা লাগছে।
রোদ শুরু হয়ে গেছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে ডাবের লীলা। যেখানে সেখানে বসে গেছে ডাবের বেসাতি। গাছতলায়, ফুটপাথে, পানের দোকানে। দোকানি ক্ষিপ্রহাতে ডাবের মুখ কেটে এগিয়ে দিচ্ছে পিপাসার্তের মুখের কাছে।
কেউ এমনিই গলায় ঢালছে, কেউ কায়দা করে কাগজের খড় ডুবিয়ে খাচ্ছে।
সরোজাক্ষ ভাবলেন, সহজ হতে পারার হয়তো আলাদা একটা সুখ আছে। আমি ভাবতেই পারি না রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনও কিছু খাচ্ছি। অথচ এরা অনায়াসেই
শুধু ডাব কেন, বহুবিধ বস্তুই।
শহরের রাস্তা অজস্র লোভনীয় খাদ্য পানীয় সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে, পথচারীর ইচ্ছের ঘরের দরজায় টোকা দিচ্ছে, খাবে না তারা? খাবেই তো।
সরোজাক্ষ পারেন না, সেটা সরোজাক্ষর ত্রুটি। সবাই যেটা করছে, সেটা করতে না পারা একটা ত্রুটিই নিশ্চয়ই। যে ত্রুটিটা অন্যের কোনও অসুবিধে ঘটায় না, অসুবিধে ঘটায় নিজের।
স্যার, আপনি এ সময় এখানে?
একটি ছেলে নিচু হয়ে প্রণাম করতে এল।
থাক থাক! দুপা পিছিয়ে সরে এসে তাকালেন সরোজাক্ষ, কে?
স্যার আমি শিখরেন্দু। আমি শিখরেন্দু বলেই নিশ্চিত হল ছেলেটা। তার মানে ধরে নিল, ওইটুকুতেই সব বলা হয়েছে। স্যার নিশ্চয় বুঝে নেবেন, একে পড়িয়েছেন, এবং কবে পড়িয়েছেন।
কথাটা ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। ভাবলেন, কেন নয়? কেনই বা প্রত্যাশা থাকবে না এদের, যাঁর কাছে তিন চার বছর ধরে পড়েছি তিনি আমার মুখটি দেখে, অথবা নামটি শুনে চিনে ফেলবেন?
হয়তো এ আমার খুব প্রিয় ছাত্রই ছিল, হয়তো খুব মেধাবী ছিল, কিন্তু সেসবের কিছু মনে নেই আমার।
সরোজাক্ষ ভাবলেন, কিংবা এ হয়তো সেদিনের সেই ঘেরাওয়ের দলেই ছিল। এখন দলছাড়া। তাই এখন নিজের ভদ্রসত্তাকে ফিরে পেয়েছে। অথবা হয়তো প্রাক্তন ছাত্র।
সরোজাক্ষ তাই চেনা-অচেনার মাঝামাঝি একটুকরো সৌজন্যের হাসি হেসে বলেন, আমিও তোমায় সে প্রশ্ন করতে পারি।
যখন স্যার বলে পায়ের ধুলো নিতে এসেছে, তখন তুমি বলাই শোভন।
আমার কথা বলছেন? ছেলেটা যেন নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলোয় আছড়ে ফেলে দিয়ে বলে, আমাদের কথা বাদ দিন। কাজের ধান্দায় সময় অসময় বলে কিছু নেই। সেই পঁয়ষট্টি সাল থেকে কী না করছি, কোথায় না ঘুরছি, কাকে না ধরছি, ঠিকমতো একটা কিছুই পাচ্ছি না।
পঁয়ষট্টি সাল!
তার মানে প্রাক্তন।
তার মানে ঘেরাওদের দলের নয়।
সরোজা ঈষৎ নিশ্চিন্ত চিত্তে বলেন, আছো কোথায় এখন?
আছি এখানেই। তালতলায় সেই পিসির বাড়িতেই আছি, একটা কিছু জোগাড় করে ফেলতে পারলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসব। একা-একা থাকেন
নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলিতে নিক্ষেপ করার ভঙ্গি করলেও, নিজের কথাই সাতকাহন ছেলেটার।
শেষ বয়েসেও যদি মাকে একটু শান্তি দিতে না পারলাম, তবে আর কী হল। কিন্তু বলব কি স্যার, চাকরির বাজার যা হয়েছে–ব্যাকিং না থাকলে কার সাধ্য কিছু জোটাতে পারে।
সরোজাক্ষ এই জোলো জোলো আক্ষেপ আর জোলো জোলো মাতৃভক্তির বুলি শুনে মৃদু হাসলেন। এই ধরনের ছেলে বলেই বোধ হয় গুরু-শিষ্য সম্পর্কটা বজায় রেখেছে মনের মধ্যে। ভাবলেন, মাকে শান্তি দিতে না পারার আক্ষেপের পিছনে আর একটি আক্ষেপও কাজ করছে বইকী! মনকে চোখ ঠারা, ভাবের ঘরে চুরি, মাকে শাস্তি দেওয়া!
ওই আত্মপ্রতারণার বশে যা হোক একটা চাকরি জুটলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশ থেকে এনে ফেলে মার সেবিকা এনে হাজির করবে, তারপর আবার কিছুদিন পরেই মাকে শাস্তি দিতে ফের দেশের বাড়িতে রেখে আসবে। তফাতের মধ্যে এখন সপ্তাহে মাকে দেখতে যাওয়া, তখন সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুধু মনি অর্ডারের ফরমে মাতৃ-সম্বোধনযুক্ত চিঠি।