মানুষ যদি সভ্যতার শৃঙ্খলে বাঁধা না পড়ত? মানুষ যদি অনেক না চাইত? সরোজাক্ষ যেন নিজের প্রশ্নে নিজেই কৌতুক অনুভব করে নিজেকে একটি সরস উত্তর দিলেন।
তা হলে বাসে এত ভিড় হত না।
দাদু কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?
থমকে তাকালেন সরোজাক্ষ।
কে কাকে বলল কথাটা! এমন ভোলা ধারালো গলায়! আমাকেই নয় তো? অবহিত হয়ে তাকালেন, ওই প্রশ্নের লক্ষ্যের প্রতি লক্ষ করবার চেষ্টা করলেন।
প্রশ্নকর্তাকে দেখতে পেলেন না।
অতএব লক্ষ্যটা সরোজাক্ষ নয়।
সরোজাক্ষ এবার উত্তর শুনতে পেলেন, তাই দেখতে পেলেন লক্ষ্যটিকে। শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ, পরনে অর্ধমলিন ধুতি এবং হাওয়াই নয়, পুরনো আমলের একটা জিনের কোট। কোটের উপর আবার গলায় পাক দিয়ে একখানা র্যাপার জড়ানো। র্যাপার গায়ে দেবার মতো শীত আর অবশিষ্ট নেই, তা ছাড়া দুপুর রোদ। অথচ রোদটা যে প্রখরতা লাভ করেছে সে খেয়াল ভদ্রলোকের নেই তা নয়, দেখা যাচ্ছে রোদের প্রতিষেধক ছাতাটি রয়েছে বগলে।
সরোজাক্ষর মনে হয়, এ এবং এদের মতো লোকেরা হয়তো এই শহরের বাসিন্দা নয়, হয়তো মাথার উপর যে আকাশ আছে, সেটা এরা সন্ধ্যাতারার স্নিগ্ধ আলোকে টের পায়, তবু এই দুপুরের রোদে ঠেলাঠেলি করতে এই শহরে আসে ভিড় বাড়াতে।
আসে, কারণ এরা ভুলে গেছে এদের পিতামহ প্রপিতামহ জানত মাটির নীচে অন্নজল সঞ্চিত থাকে।
বুড়ো ভদ্রলোক উত্তর দিলেন,আমায় বলছ?
একটা রোগা সিঁড়িঙ্গে ছেলে, যে ধরনের চেহারা এবং সাজসজ্জা রকের আড্ডায়, রাস্তায় ইট পেতে ক্রিকেট খেলায়, সর্বজনীন প্রতিমা ভাসানোর লরিতে টুইস্ট নাচে অথবা দুপুর রোদে সিনেমার টিকিট কাটার লাইনে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি ছেলে, মুখে একপোঁচ ব্যঙ্গের প্রলেপ মেখে উত্তর দেয়,আজ্ঞে হ্যাঁ দাদু, অনেকক্ষণ থেকে আপনার ছাতার খোঁচায় হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে কি না!
হয়তো ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে ওই ভাষাটা চট করে প্রবেশ করল না, তাই তিনি অবাক অবাক গলায় বলেন, কী বলছ?
দাদু বুঝি কানে একটু কম শোনেন?
বাসের মধ্যে একটু মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল। সন্দেহ নেই ছোকরার ওই ব্যঙ্গোক্তি সবাই বেশ উপভোগ করছে।
বেচারি বুড়ো ভদ্রলোকের শীর্ণমুখে একটা দীর্ণ হাসি ফুটে ওঠে, আমাদের মতো হতভাগ্যের কানে কম শোনাই ভাল ভাই।
তা অবিশ্যি–ছোকরা খুক খুক করে হেসে বলে,অন্যের পাঁজর বিদীর্ণ করে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাবেন, সরুন মশাই বললে শুনতে পাবেন না। তা ছাতাটা দয়া করে একটু নামান দাদু!
ভদ্রলোক ছাতাটাকে টেনে হিঁচড়ে একটু নামিয়ে কাতর গলায় বলেন, আমাদের মতো শক্তিহীন লোকের আর এই বাসে-ট্রামে চড়া চলে না।
আহা আমিও তো তাই বলছি দাদু–ছোকরা জিভে একটু চুকচুক শব্দ করে বলে,কেন কষ্ট করে রোদে বেরিয়েছেন? দিব্যি শীতলপাটি বিছিয়ে, ঘরে বসে দিদিমার হাতের বেলের পানা খাবেন, আর তালপাখার হাওয়া খাবেন, তা নয়, এই আমাদের পাঁজরে ছাতার খোঁচা দিতে
এবার আর মৃদু গুঞ্জন নয়, সারা বাসে একটা স্পষ্ট হাসির ঢেউ খেলে যায়।
স্বাভাবিক।
কৌতুকের কথায় কৌতুক-হাসি হাসবে না লোকে?
বিশেষ করে যখন অনেকে একত্রে রয়েছে। অনেকজন যখন একত্র হয়, তখন তো আর তারা ব্যক্তি থাকে না, হয়ে যায় জনতা।
জনতা একটা আলাদা জাত।
যে জাতের সংক্রামতা প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই।
যে কোনও ব্যাধিই তাকে মুহূর্তে গ্রাস করতে পারে।
যে কোনও ঘটনাই তাকে মুহূর্তে অনুপ্রাণিত করতে পারে। যে কোনও সবল কণ্ঠই তাকে অনুবর্তী করে ফেলতে পারে।
তাই জনতার মধ্যে একজন যদি হঠাৎ সভ্যতার বেড়া ডিঙোয়, সঙ্গে সঙ্গে সবাই অসভ্য হয়ে ওঠে। একজন যদি গালাগালি করে তো, সবাই গালাগালি শুরু করে দেয়–কেন, কাকে, কী জন্যে, সে চিন্তা না করেই।
তা হাসিও একটা সংক্রামক ব্যাধি, যদি সেটা ব্যঙ্গ হাসি হয়। অতএব এ ব্যাধি জনতার মধ্যে সংক্রামিত হতে দেরি হয় না। আর হয় না বলেই, যারা তার পথিকৃৎ, তারা চেষ্টা করে করে আরও কৌতুক কথার আমদানি করে, যাতে লোকে আরও হাসে।
অনেক লোকেরই এ-প্রবণতা দেখা যায়, তোক হাসানো। এমনিতে হয়তো তারা সুরসিক বলে খ্যাত নয়, কিন্তু বিশজন লোককে একত্রে দেখলেই তাদের রসনা আপনিই সরস হয়ে ওঠে। ট্রামে বাসে রেলগাড়িতে উঠলেই এরা কথায় ফুলঝুরি ঝরাতে আরম্ভ করে, ও দাদা, দয়া করে শ্রীচরণটি একটু গোটান। নইলে–এ-অভাগা যে মারা যায়। না-না, মাদুর গোটানো করে গোটাতে বলছিনা, জাস্ট একটু মুড়ে বসা।
ও দাদু, কৃপা করে যদি বিছানাটা একটু তোলেন।–আহা, ইস্ ইস্ দাদুর বুঝি দিবানিদ্রার অভ্যাস, তাই দিনদুপুরেই বিছানা বিছিয়ে–..
মাসিমা বুঝি ট্রান্সফার হয়ে অন্য কোথাও সংসার পাতাতে যাচ্ছেন? মাল মোটের বহর দেখছি কি না
এক একটি কথার সঙ্গে সঙ্গেই সারা কামরায় হাসির ঢেউ ওঠে, তা সে কথা যতই পচা পুরনো সস্তা স্থূল হোক। এতএব রসিক ব্যক্তিটি উদ্বেলিত হয়ে উঠে নব নব রসে পরিবেশন শুরু করে দেন। জুড়োতে দিতে চান না। একে ঠাণ্ডা করতে পারে একমাত্র রাজনীতি। সেটাও–ভয়ংকর রকমের সংক্রামক ব্যাধি তো! আর–সেটা যে-কোনও রসের পিছনেই গুঁড়ি মেরে বসে থাকে, এবং সহসা উঁকি মেরে মুখটি বাড়িয়ে দেয়।
এই জীর্ণ বৃদ্ধকে নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি হতে হতে হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা রাজনীতিতে পৌঁছবে, কিন্তু সরোজাক্ষ তার আগেই নেমে পড়লেন।