কিন্তু একে এখন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, এতদিনের অবহেলার মাশুল দিতে হবে। আবার চাবিবন্ধ করলেন গ্যারেজের, রাস্তায় নামলেন, বাসস্টপের দিকে এগোলেন।
রোদে বেরোনো ডাক্তারের নিষেধ ছিল সরোজাক্ষর, ভিড়ের মধ্যে ট্রামে বাসে চড়া নিষেধ ছিল, সে নিষেধ এতদিন মেনেছিলেন সরোজাক্ষ। ডাক্তারের আদেশের প্রতি নিষ্ঠাবশতই যে মেনেছিলেন তা নয়, যেন নিষ্ক্রিয়তার একটা কফিনের মধ্যে নিজেকে পুরে ফেলে এই একখানা ঘরের মধ্যে কবরিত করে ফেলেছিলেন নিজেকে।
কেন?
সে কথা সরোজাক্ষ নিজেও বোধ করি জানেন না। হয়তো সহসা একটা বড় আঘাতে অসাড় হয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো বা অসাড় চিত্ত সহসা একটা বড় আঘাত পেয়ে বহু চিন্তায় সচেতন হয়ে উঠেছিল বলে চিন্তার দুর্গে বন্দি করে ফেলেছিলেন নিজেকে।
আজ আবার সহসাই যেন সব নিষ্ক্রিয়তার খোলস খুলে বার করে আনলেন নিজেকে সমর্পণ করলেন জনারণ্যের মধ্যে।
কিন্তু কেন?
কেন হঠাৎ আবার আজ আপন সৃষ্ট দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল সরোজাক্ষর? আর বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লেন কেন?
সরোজাক্ষ কি তবে হঠাৎ তাঁর সংসারের ক্লেদাক্ত ঘটনা শুনে ফেলেছেন, তাই বিচলিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সেই সংসারের গণ্ডি থেকে?
কিন্তু কই? তা তো নয়।
বিজয়া তো সেই কলঙ্কিত কথা এ পর্যন্ত সযত্নে স্বামীর কাছ থেকে গোপন করেই আসছে। জানেন কেউ কাছে গিয়ে না বললে, টের পাবার ক্ষমতা নেই সরোজাক্ষর। বিজয়া এখনও পর্যন্ত আশা করছিলেন, হয়তো শেষ অবধি মীনাক্ষীর সুমতি হবে, হয়তো গোপনটা গোপনই থেকে যাবে।
স্বামীকে বিজয়া কোনও ব্যাপারেই ভয় করেন না, স্বামীর পছন্দ-অপছন্দকে তোয়াক্কাই করেন না। কিন্তু এবারে একটু বে-পোটে পড়ে গেছেন। এবারে ভয় জন্মেছে।
অথচ এ ভয় করবার কথা ছিল না।
অন্তত বিজয়ার প্রকৃতিতে ছিল না।
বিজয়ার প্রকৃতিতে তো স্বাভাবিক ছিল স্বামীর কাছে এসে ফেটে পড়ে মেয়েকে যথেচ্ছ বিচরণের সুযোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁকেই বাক্যবাণে বিদ্ধ করে জর্জরিত করা এবং মেয়েকে বিজয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী মানুষ করতে দিলে যে আজ এমন কেলেঙ্কারি ঘটতে পারত না, সেটাও সগৌরবে ঘোষণায় বুঝিয়ে ছাড়া।
কিন্তু বিজয়া তা করেননি।
বিজয়া ভয় পেয়েছেন, ওই ধিক্কারটা তাঁর নিজের উপরই আসবে ওই আশঙ্কায়। বিজয়া ভেবেছিলেন, সরোজাক্ষ নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে থেকেই বিজয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারেন। সরোজাক্ষ একটিমাত্র ঘৃণার বাণী উচ্চারণ করে মা আর মেয়েকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারেন।
বিজয়া বুঝতে পেরেছিলেন, সেই নিঃশব্দ ধিক্কারের, সেই একটি ঘৃণার বাক্যের সামনে বিজয়া মুখ খুলতে পারবেন না। মর্যাদাজ্ঞানহীন বিজয়া স্বামীর হৃদয়-দুর্গে প্রবেশের পথ না পেয়ে চিরকাল সেই দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন, আর ভেবেছেন, এটাই বুঝি বিজয়, কিন্তু হঠাৎ যেন সেই পদ্ধতির মধ্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। মীনাক্ষী নামের ওই মেয়েটা যেন বিজয়াকে শক্তিহীন করে ফেলেছে। বিজয়া অনুভব করছেন মিথ্যা মর্যাদার প্রাসাদটাকে আর বুঝি রক্ষা করা যাবে না।
নিজের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে অনেক চেষ্টা করেছেন বিজয়া, ভেবেছেন–মেয়েদের যথেচ্ছাচার করবার সুযোগ দেবে তোমরা এ যুগে, দেবে যথেচ্ছ বিচরণের স্বাধীনতা, অথচ সেই মেয়েরা যদি নির্বোধের মতো আগুনে পা ফেলে তখন দোষ হবে মায়ের? সকলে সকলরবে বলবে, মায়ের শিক্ষা শাসন থাকলে এমন হতে পারে না, মায়ের দায়িত্বজ্ঞান ঠিক থাকলে মেয়ের সাধ্য কী? মা বেহুঁশ, তাই এমন বেয়াড়া কাণ্ড ঘটে বসেছে।
হ্যাঁ, এই কথাই বলবে লোকে।
বিজয়া যেন সেই লোক-মুখগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন, তাই বিজয়া ক্রমশই সাহস হারাচ্ছেন। আর তাই বিজয়া মেয়েকে তিরস্কার করার পালা শেষ করে এখন তাকে তোয়াজের পালা ধরেছেন। মীনাক্ষী যদি এতটুকু সদয় হয় মায়ের উপর। মীনাক্ষী যদি একবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, তা হলেই সব সমস্যা মিটে যায়। মীনাক্ষী কঠিন হয়ে বসে আছে, তবু বিজয়া সেই কাঠিন্য গলাবার চেষ্টা করে চলেছেন।
তাই বিজয়া এখনও স্বামীর আছে উদঘাটিত করে বসেননি তাঁর এই চারখানা দেয়ালের মধ্যে কোন দুরপনেয় কলঙ্কের ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
অতএব সরোজাক্ষর এই হঠাৎ কাউকে না বলেকয়ে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে বিজয়া-ঘটিত কোনও ঘটনা নেই। সরোজাক্ষ এমনিই বেরিয়েছেন। হয়তো বাইরের পৃথিবীটাকে ভুলে যাচ্ছি ভেবে বিচলিত হয়েছেন।
ডাক্তারের নিষেধ, তবু সরোজাক্ষ একটা ভিড়ের বাসেই উঠে পড়লেন। কিন্তু ভিড়ের ছাড়া হালকা বাস পাচ্ছেন কোথায়? এই ভরা দুপুরেও তো রড ধরে ঝুলছে লোকে।
আশ্চর্য, কত লোক পৃথিবীতে! কত লোক এই শহরটায়!
মাটির নীচেই যে অন্ন জল লুকোনো আছে, শুধু খুঁড়ে বার করার ওয়াস্তা, এ কথা যেন ভুলেই যাচ্ছে। মানুষ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই শুধু লোহালক্কড়ের কাছে ছুটে আসছে। আসছে পাথরের প্রাসাদের দরজায়। যেন সব অন্ন শুধু সেখানেই জমা আছে।
অথচ এখনও মাথার উপরের আকাশ ফুরিয়ে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি মাটির রস।
শুধু আমরাই ফুরিয়ে যাচ্ছি।
লোভের তাড়নায় একটা শূন্যতার গহুর লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে, হারিয়ে ফেলছি আমাদের সত্তাকে। অতএব লক্ষ্যে পৌঁছবার পরিতৃপ্তি নেই, সাফল্যের আনন্দ নেই, আছে শুধু শেষ অবধি হুমড়ি খেয়ে সেই শূন্যতায় আছড়ে পড়া।