নচেৎ বারো মাসই বিজয়া ওই ধুলো জঞ্জাল ভরা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদটাকে সামনে নিয়ে নিজের সেই ছোট্ট এল শেপ কুঠুরিটিতে বসে থাকেন, কে জানে ধ্যানমগ্ন হয়ে কিংবা জপের মালার হিসেব নিয়ে।
দোতলাটা ভরা ভর্তি।
দোতলায় অনেক ঘর।
সিঁড়িতে উঠেই বড় দালান, দালানের দুপাশে ঘরের সারি। দক্ষিণের সারিতে প্রথমেই সরোজাক্ষর নিজের ঘর, তার পাশে অবিবাহিত পুত্র কমলাক্ষর ঘর, আপাতত সে এখন খঙ্গপুরে পড়তে গেছে, তাই ঘরটা ফাঁকা। কমলাক্ষর ঘরের পাশে সরোজাক্ষর দুই মেয়ের ঘর, যার মধ্যে একজন বিবাহসূত্রে ঘরের দখল ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, অপরজনও যাই-যাই করছে। তবে এখনও সে এ ঘরে সবলে প্রতিষ্ঠিত। নিজের জিনিসপত্র ব্যতীত কারও একখানা রুমালকেও প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ সে। হয়তো ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই তার দাবির ভাষা এত জোরালো। জোরের যেখানে ভিত নেই, সেখানেই তো মুখের আস্ফালন।
শুধু দিদি এলে মীনাক্ষী ঘরের দখল ছেড়ে মায়ের ঘরে শুতে যায়। কারণ দিদি অর্থেই তো জামাইবাবু।
কমলাক্ষর ঘরটায় কেউ শুতে রাজি হয় না। ঘরটার একটা বিরাট দোষ সরোজাক্ষর ঘরের সঙ্গে তার যে ব্যবধান প্রাচীর, সেটা একটা কাঠের পার্টিশন মাত্র। কথা বললে শোনা যায়। গুনগুনিয়ে গান গাইলে শোনা যায়, রাত জেগে গল্পের বই পড়লে আলো দেখা যায়।
সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা ইচ্ছাসাপেক্ষে বাবার জ্ঞানগোচরে আসতে রাজি নয়।
মীনাক্ষীর ঘরের পরে, সামনে খোলা বারান্দাওলা সবচেয়ে বড় ঘরখানা সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষর। সস্ত্রীক সপুত্র তার সেখানে বসতি। মীনাক্ষীর ঘরের মধ্যে দিয়ে মাঝখানে যে দরজাটা আছে, সে-দরজার ওপর একটা আলমারি চাপিয়ে রেখে নীলাক্ষ নিজের জন্যে একটা অন্য ভুবন গড়ে নিয়েছে। ওর ঘরে কেউ কদাচিৎ ঢোকে।
উত্তরধারে খানিকটা অংশ বারান্দা বাবদ খরচ হয়ে যাওয়ায়, ঘর দক্ষিণের মতো চারখানা না হয়ে তিনখানা। এই তিনখানা ঘরের দুখানা ঘর গৃহিণীর অধিকৃত। একখানায় তিনি মাত্র রাত্রিটুকুতে দেহরক্ষা করেন (আর সময় কোথা তাঁর?), বাকিখানায় সুরক্ষিত রাখেন তাঁর সাংসারিক মালপত্রের বোঝা। সে ঘরে নেই এমন জিনিস নেই। বাসনের সিন্দুক থেকে শুরু করে ভাঙা লোহা পর্যন্ত, বাড়তি বিছানা থেকে শুরু করে তোশক ঘেঁড়া টিকিন পর্যন্ত, সব জমানো আছে বিজয়ার সেই ঘরে। আছে ঘি-তেলের খালি টিন, কাঠি ফুরনো দেশলাই বাক্স, মশলা বাঁধা দড়ি, বাসি খবরের কাগজ, পরিত্যক্ত ঠোঙা। আরও কত কীই আছে। স্রেফ হরেকরকমবার ব্যাপার।
এগুলিতে সংসারের কারও হাত দেবার অধিকার নেই, কারণ এ ঘরের প্রত্যেকটি জিনিসই নাকি বিজয়ার একান্ত প্রয়োজনীয় এবং নিতান্ত বিশুদ্ধ। পাছে কেউ কোনও প্রয়োজনে বিজয়ার ধ্যানমগ্নতার অবকাশে ওগুলির বিশুদ্ধতা কলঙ্কিত করে বসে, তাই ঘরটাকে বিজয়া চাবিবন্ধ করে রাখেন।
আগে আগে সরোজাক্ষ বলতেন, বসবাস করা বাড়িতে চোখের সামনে একটা দরজায় তালা ঝুলছে এটা দেখতে বিশ্রি–এখন আর বলেন না।
কারণ বিজয়া তার জবাবে বলেছেন, তোমার সংসারে আমিও তো একটা বেমানান বিশি, তবু তো আছি চোখের সামনে দৃষ্টিশূল হয়ে।
বিজয়ার কথা বলার ধরনই এইরকম।
তা বিজয়ার ছেলেমেয়েদেরও কথায় কিছু ধরনআছে। ঘরটাকে কমলাক্ষ বলে মার মিউজিয়াম। ময়ূরাক্ষী বলে, মার বৈরাগ্যের নিদর্শন; আর মীনাক্ষী বলে সাড়ে বত্রিশ ভাজার খিলি।
নীলাক্ষ ঠিক এ ধরনের কথা বলে না, সে চাপা রাগের গলায় বলে, এটা হচ্ছে স্রেফ নির্লজ্জ দখলের নমুনা। আমি কেবলমাত্র একটা ঘরে কত অসুবিধেয় পড়ে আছি, অথচ উনি আস্ত একটা ঘরে শুধু জঞ্জাল ভরে রেখে
আরও একটা বরবাদি ঘর নিয়েও চাপা সমালোচনার ঝড় বয়, কিন্তু সরোজাক্ষর মুখোমুখি এসে পৌঁছয় না ঝড়টা। ওই জায়গাটায় যে সরোজাক্ষর মনোভাব অনমনীয়, সেটা সকলেরই জানা। সে ঘরটা ঠিক সিঁড়িতে উঠেই বাঁ হাতি, অর্থাৎ সরোজাক্ষর ঘরের সামনাসামনি। ঘরটার দরজায় একটা ছিটের পরদা আছে বটে, কিন্তু সেটা ঝোলানো থাকে কদাচিৎ, ওলটানোই থাকে সব সময়, কাজেই ঘরের অধিকর্তাকে সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়।
নীলাক্ষর মতে সেটাও একটা কুদৃশ্য, কিন্তু ওর আর প্রতিকার নেই। লোকটা নীলাক্ষর ঠাকুর্দার জামাই, আর এ-সংসারে আছে সেই ঠাকুর্দার আমল থেকেই। মগজে ছিটওয়ালা বেকার জামাইটিকে ভদ্রলোক দিব্যি জামাই আদরেই প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন। সরোজাক্ষও সেই আসন থেকে টেনে নামাননি তাকে। বোন কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, ভগ্নীপতি রয়ে গেছে। এখনও তার জন্য যখন তখন রাবড়ি আসে, রাজভোগ আসে, বড় গলদা চিংড়ি, রুইমাছের মুড়ো আসে। তার বাসনা হলেই আসে। এই বিরাট দৃষ্টিশূল জিনিসটাও সয়ে যেতে হয় সরোজাক্ষর সংসারকে।
কারণ ওটা সরোজাক্ষর স্পেশ্যাল খরচ।
ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই আতিশয্যে এই অপচয়ে বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক, অপর আত্মীয়রা অথবা অনাত্মীয়রাও শুনে বলে অনাসৃষ্টি। কিন্তু সইতে হচ্ছেই।
ছেলেবেলায় অবশ্য পিসিবর্জিত পিসেমশাই ছেলেমেয়েদের কাছে রীতিমত আকর্ষণের বস্তু ছিল। কারণ ছেলে ভোলানোর বহুবিধ কৌশল ছিল তার আয়ত্ত। বলতে কি, নিজেই সে শিশু বনে যেতে পারত, সমবয়সী হয়ে যেতে পারত ওদের।
কিন্তু ওরা তো আর কেউ চিরশিশু নয়। ওদের শৈশব যথাসময়েই গত হল এবং সেই অতিক্রান্ত শৈশববিজ্ঞেরা তাদের সদ্যলব্ধ জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা বুঝে ফেলল কী ঘোরতর একটা অপচয়ের ধারা অনাহত স্রোতে বয়ে চলেছে সংসারে।