তারা বাজার করে রান্না করে, তুচ্ছ বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প করে রাগ করে ঝগড়া করে, আবার বলে, বলেছ যখন, তখন না করে উপায় কী?
দাম্পত্য জীবনের এই ছবিই দেখেছে সুনন্দা তার কুমারী জীবনে।
দেখেছে কখনও মা বাবাকে ভয় করে, কখনও বাবা মাকে ভয় করে। কখনও মা কোনও কাজ করে মেয়ের কাছে চুপিচুপি বলেছে, এই, দেখিস যেন তোর বাপ না জানতে পারে। যা রাগী মানুষ, টের পেলে আর রক্ষে রাখবে না।
কখনও বাবা কোনও কাজ করে মেয়েকে বলেছে, দেখিস বাবা তোর মা যেন না টের পায়, পেলে কেঁদে-কেটে অনর্থ করবে। যা ছিচকাঁদুনে মানুষ!
সুনন্দা বড় মেয়ে, তাই সুনন্দার সঙ্গেই পরামর্শ।
কিন্তু কীই বা সেই কাজগুলো? ভাবলে এখন হাসি পায় সুনন্দার। হয়তো মা একটি ছিট কাপড়-ফেরিওয়ালা ডেকে দুগজ ছিট কিনেছে, নয়তো বা একটা বাসনওলা ডেকে পুরনো বাসন বদলে দুটো বাটি কিনেছে। আর বাবা হয়তো সুনন্দার জন্যে জুতো কিনতে এসে পাঁচ টাকার জুতো কিনে নিয়ে গিয়ে অম্লান বদনে বলেছে, এইটুকুন জুতো আট টাকা দাম নিল, বাজার দেখেছ? হয়তো সুনন্দার মার ফরমাশি কিছু কিনতে এসে দাম দেখে পিছিয়ে গিয়ে দরাজ গলায়ে বলেছে, কোথাও পেলাম না বুঝলে? পাঁচ সাতটা দোকান ঘুরলাম, বলে ওটা আজকাল আর পাওয়া যায় না।
ষড়যন্ত্রের অংশীদার সুনন্দা দোকান বাজারে বাপের সঙ্গে থেকেছে, তাই সেও সোৎসাহে বলেছে, উঃ হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে।
আর বাবা যদি কখনও প্রশ্ন করেছে, এই তোর মা দুপুরবেলা ফেরিওলাটোলা ডাকে না তো?
সুনন্দা অপার্থিব মুখ করেছে, না তো বাবা!
এই! এমনিই সব ঘটনা নিয়ে তাদের মান অভিমান, ভয়, লুকোচুরি! প্রায় ছেলেমানুষের মতো। এই জানত সুনন্দা।
আক্রোশ নয়, হিংস্রতা নয়, একজন অপরজনকে হেয় করবার চেষ্টায় উন্মুখ হয়ে থাকা নয়, হৃদয়ের বন্ধনহীন একটা প্রতিপক্ষের ভাব নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকার নির্লজ্জতা নয়।
এরা কি তুচ্ছ? ক্ষুদ্র? অসম্ভ্রান্ত?
এ বাড়িতে এসে সুনন্দা দাম্পত্য জীবনের তার সেই পরিচিত ছবি দেখতে পায়নি। তারপর নিজের জীবনে ।
সুনন্দা জানে নীলাক্ষ তার অতি সাধারণ শ্বশুর-শাশুড়িকে কৃপার চক্ষে দেখে। প্রয়োজনের খাতিরে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করলেও কখনও সমীহের দৃষ্টিতে তাকায় না।
অভাবের মধ্যে থেকেও যারা সুখে থাকতে পারে, তাদের প্রতি বড় অবজ্ঞা নীলাক্ষর।
নীলাক্ষ টাকার অভাবটাকেই একমাত্র অভাব বলে জানে। সেই অভাবটাই উঠেপড়ে লেগে ঘোচাতে চেষ্টা করেছিল নীলাক্ষ সুখ পাবার আশায়।
আর সেই চেষ্টায় মূলধন করেছিল সুনন্দাকে। তাই যখন সুনন্দা হাসিতে কটাক্ষে নাচে গানে তার ডিলারদের মুগ্ধ করে বড় বড় একটা কাজ গুছিয়ে দিয়েছে, তখন নীলাক্ষ সুনন্দাকে আদরে ডুবিয়ে বলেছে, তুমি আমার একটি সোনার খনি!
সুনন্দা বলত,আমাকে ভাঙিয়ে তুমি বড়লোক হতে চাইছ?
নীলাক্ষ অম্লানবদনে বলত, তা ভাঙাবার মতো আর কী সম্পত্তি আমার আছে বলো?
এ বাড়িতে এসে নিজের জীবনে এই দাম্পত্য সম্পর্ক দেখতে পেল সুনন্দা। তবু সুনন্দা এবাড়িতেই রয়ে গেছে।
আশ্চর্য!
তবে কি ওই লোকটার জন্যেও ভালবাসা রয়েছে সুনন্দার? সুনন্দা তাই ভাবতে চেষ্টা করেছে, আর কিছু নয় ও নির্বোধ, বড় বেশি নির্বোধ, তাই বুঝতে পারছে না কীসের বদলে কী কিনছে।
কিন্তু ভালই যদি বাসে, ওকে তবে সব সময় বিধতে ইচ্ছে করে কেন সুনন্দার?
ব্যঙ্গ হাসির ছুরি দিয়ে, ধারালো কথার তীর দিয়ে দিয়ে?
জানে না, কেন।
তবু নীলাক্ষ যখন তার বোনের কাছ থেকে ফিরে এসে হতাশ গলায় বলে, রাস্কেলটার ঠিকানা দিলে না? তখন সুনন্দা সেই তীর মারে। বলে, অত বিচলিতই বা হচ্ছ কেন গো? তুমি তো এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলে না? মেয়েদের জীবনে এ তো একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। পবিত্রতা সতীত্ব এসব তো তোমার কাছে স্রেফ কুসংস্কার।
নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, সতীত্ব মানে? ওর কি বিয়ে হয়েছে?
ও হো হো তাই তো বটে! সুনন্দা হি হি করে হাসে, কী বোকা আমি। হি হি হি। পতি না হলে আর সতী? সত্যি, আমি এমন বোকা কেন বলো তো?
আচ্ছা, অস্বাভাবিকের ভান করতে করতে সুনন্দা কি শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক হয়ে যাবে?
.
গ্যারেজের চাবি খুলে ঢুকে গাড়িটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন সরোজাক্ষ। ধুলো জমেছে বিস্তর, সরোজাক্ষর সেই অসুখ হয়ে পড়ার পর থেকেই তো চাবিবন্ধ পড়ে আছে।
নীলাক্ষ গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে তীব্রদৃষ্টিতে দেখে দেখে ফুটপাথে নেমে ট্যাক্সি ডাকে।
কমলাক্ষ যখন এসেছিল কদিনের জন্যে, সেও বলেছিল, বসে থেকে থেকে তো জং ধরে গেল ওটায়, চাবিটা বাগিয়ে আনো না মা, একবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
বিজয়া প্রথমে বলেছিলেন, হ্যাঁ, মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে এসেছ, এবার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে হাত-পা ভাঙো। চালাতে শিখলি কবে যে গ্যারেজের চাবিটা পেলেই চালাবি?
তারপর বলেছিলেন, চাবি উনি দিলে তো? ওই গাড়িটা তো তোদের বাপের কাছে গাড়ি নয়, ওঁর মরে যাওয়া কাকা!
সরোজাক্ষ অবশ্য শুনতে পাননি সে কথা। শুনলে হয়তো অবাক হয়ে ভাবতেন, বিজয়া কবে আমায় এমন নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ে ফেলল?
বাস্তবিকই বুঝি সরোজাক্ষর হৃদয়ে গাড়িটা সম্পর্কে ওই রকমই একটি ভাবপ্রবণতা আছে। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে যেন কোনও প্রিয় স্মৃতির গা থেকে বিস্মৃতির ধুলো ঝাড়লেন।