.
মেয়ে যখন আসত, তখন রোজ আসত, রোজ থাকত। আবার এখন আসে না তো আসেই না।
সুনন্দার মা উদ্বিগ্ন হন।
মেজাজি জামাই কোনও কারণে রেগে-টেগে যায়নি তো? অথবা মেয়ে?
মহিলাটি নেহাতই সাদাসিধে গেরস্তালি ধরনের। ক্ষুদ্র একটি পরিধির মধ্যে সারা জীবন কাটিয়ে এলেন, কিন্তু নিজেকে কোনওদিন ক্ষুদ্র ভেবে মরমে মরেননি, বিধাতাকে অভিশাপ দেননি। তিনি জানেন, তাঁর হাতে যেটুকু আছে সেইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, সেইটুকু দিয়েই স্বর্গের সাধনা করতে
মেয়েটিকে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ কেমন করেই যে বদলে গেল সেই মেয়ে!
সেই বদলের চেহারাটা সুনন্দার মার কল্পনার বাইরে ছিল।
সুনন্দার মা মেয়ের সেই বদলে যাওয়ার রূপ দেখে ভীত হতেন, লজ্জিত হতেন, ব্যথিত হতেন, কখনও কখনও ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে যেতেন, তবু সাহস করে তার ব্যবহারের সমালোচনা করতে পারতেন না। পারতেন না, পাছে সেই সমালোচনার ফলে সে আর না আসে।
মাতৃহৃদয় যে সেইখানেই অসহায়।
পাছে আমার কাছে আর না আসে। পাছে আমাকে আর মা বলে না ডাকে।
এই এক ভয়ংকর ভয়ে মাতৃহৃদয় জেনেবুঝেও অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়ে দোষীর কাছে দোষী সাজে।
সেই দোষী মূর্তিতেই সুনন্দরা মা স্বামীর কাছে প্রায় কেঁদে পড়লেন। কতদিন আসেনি ওরা, তুমি একবার আসতে বলবে না?
সুনন্দার বাবা গম্ভীরভাবে বলেন, যখন ওদের আসার ইচ্ছে হত, আসত। বরং অতিরিক্তই আসত। এখন ইচ্ছে হয় না আসে না, আসতে বলতে যাবার দরকারটা কী?
পিতৃহৃদয় মাতৃহৃদয় থেকে অনেক বেশি যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী।
সুনন্দার বাবা মেয়ে-জামাইয়ের তখনকার সেই বেয়াড়া আবদারের বোঝা মুখ বুজে সহ্য করে। গেলেও মনে মনে রীতিমত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন, এখন যে আর তাদের সেই প্রত্যহ আসার হুল্লোড়টা নেই, তাতে যেন খুশিই আছেন ভদ্রলোক।
মেয়ে-জামাইয়ের নিত্য আগমনে তিনি তো প্রায় সংসারে অবান্তর হয়ে পড়েছিলেন। খাওয়ার অনিয়ম, শোয়ার অনিয়ম, বিশ্রামের অনিয়ম। তারপর দুরন্ত একটা বাচ্চা ছেড়ে রেখে দিয়ে নিত্যই তাদের কেটে পড়া। গৃহিণী অতএব কর্তাকে গৃহকর্তার বদলে, গৃহভৃত্যের পোস্টটা দিয়ে রেখেছিলেন।
জামাইয়ের জন্যে খাবার আনতে ছোটো, মাংস আনতে ছোটো, নাতি কাঁদলে তাকে সামলাতে পাতালে নামো, আকাশে ওঠো। আর পকেটে পয়সা না থাকলে পয়সা বার করো।
মহিলারা যদি সবদিকেও বুঝমান হন, দু-একটা দিকে ভীষণ অবুঝ। বাপের বাড়ি, আর জামাইবাড়ি।
সুনন্দার বাবা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন, সংসারটা একটু সমে এসেছে। হঠাৎ গৃহিণীর কণ্ঠস্বরে সেই অবুঝের আভাস পেলেন। অতএব তিনি চকিত হলেন। শক্ত হলেন।
আর সেই শক্তপোক্ত গলাতেই বললেন,আমি তো কোনওদিন তাদের যেতে বলিনি যে তাই আসতে বলতে যাব?
বাঃ তা যাবে না? রোজ আসত হঠাৎ আর একেবারেই কেন?
সুনন্দার বাবা বেজার গলায় বলেন, পকেটে টাকার ঘাটতি হয়েছে বোধহয় ফুর্তিটা কম হচ্ছে। তা ছাড়া ছেলেকে বোর্ডিঙে রেখে দিয়েছে, আর তোমায় দরকার কী?
তুমি তো চিরদিনই ওই রকম নির্মায়িকের মতো কথা কয়ে এলে। বলি–কোনও কারণে রাগ অভিমানও হতে পারে!
রাগ অভিমান? সুনন্দার বাবা তপ্ত গলায় বলেন, রাগ অভিমান কীসের? তুমি তো ফুল চন্দন হাতে করে বসে থাকো, আর আমিও কোনওদিন বলতে যাইনি এ বাড়ির মেয়ে হয়ে তুই মদ খেয়ে টলছিস? কোন লজ্জায় মুখ দেখাচ্ছিস? বলিনি, একদিনের জন্যেও বলিনি। জামাইকে যখন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে, তখন তার জন্যে রাবড়ি রাজভোগ আনতে দোকানে ছুটেছি। তবুও যদি তাঁদের রাগ অভিমান হয়, নাচার।
সুনন্দার মা অভিমানের গলায় বলেন, তুমি যে জামাইকে বিষদৃষ্টিতে দেখো তা আর আমার জানতে বাকি নেই।
বাকি নেই? তবু আমাকে দিয়ে তাকে নেমন্তন্ন করতে পাঠাতে চাইছ? বাঃ।
সুনন্দার মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, তবে কি আমি যাব?
যেতেই হবে কেন, সেটাই আমার প্রশ্ন।
সে প্রশ্ন তুমি করতে পারো, তোমার কাঠ প্রাণ। সুনন্দার মা কেঁদে ফেলেন, তারা যদি আর না আসে, তোমার তো মনেও পড়বে না কোনও দিন।
ওই তো ওইটিতেই চিরদিন জিতে এলে।
সুনন্দার মধ্যবিত্ত বাপ, তাঁর মধ্যচিত্ততারও নমুনা হন। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, বলো তো যাই, তাঁদের পায়ে ধরে নেমন্তন্ন করে আসি। মেয়ে কি আর তোমার সেই মেয়ে আছে? পেটকাটা জামা পরে পার্টিতে যাচ্ছে, মদ খেয়ে টলছে, শাশুড়ির ওপর আক্রোশ দেখাতে আর টেক্কা দিতে তোমাকে মা বলে ডেকে এসেছে। এখন হয়তো দরকার ফুরিয়েছে।
সুনন্দরা মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, তা হলে তুমি ওদের আসতে বলবে না?
না, সে কথা আর বলতে পারছি কই? তবে বেয়াইবাড়ি ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বেয়াই একটার বেশি দুটো কথা কন না, বেয়ান উৰ্ব্বলোক থেকে নামেনই না,কথা যা কই তো সেই পিসেমশাই, তা সেও তো শুনছি বিদায় নিয়েছে।
সুনন্দা তো আছে? না কি সেও গেলে কথা কইবে না?
কইতেও পারে, না কইতেও পারে। তবে যেতে যখন বলছ যেতেই হবে।
এই হচ্ছে সুনন্দার মা বাপ।
অতি সাধারণ।
তারা পরস্পরের মধ্যে কোনও দিন প্রেমের কথার আমদানি করেনি, তারা জীবনের ব্যর্থতা সার্থকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তারা তাদের জীবনকে কখনও বোঝাস্বরূপ মনে করেনি।