তাই তো ভাবে লোকে।
কাউকে তলিয়ে চিন্তা করতে দেখলে আর বিচার করতে বসতে দেখলে বলে, লোকটার মাথাখারাপ হয়ে গেছে। চিন্তাহীন বিচারহীন–শুধু অভ্যাসের স্রোতে ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিকতা, সুস্থতা।
.
একবস্তা কাগজ তো হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, বাকি বস্তাটা ভেবেছিল গঙ্গায় ফেলে দেবে, দিতে গিয়ে দিতে পারল না। গঙ্গার ঘাটে কত লোক, হাওড়া ব্রিজে কত লোক। লোকের চোখকে বড় ভয় সারদাপ্রসাদের।
হয়তো সেইটা ভেবেই মনকে চোখ ঠারছে সে। হয়তো নিজের হাতে করে জলে ফেলে দিতে বুকে বেজেছে। তাই ভাবছে, কলকাতার গঙ্গায় নয়, অন্য কোথাও। নির্জন কোনও ঘাট থেকে। আস্তে আস্তে নেমে নামিয়ে দিয়ে বলব, গঙ্গা, সারাজীবনের বৃথা স্বপ্ন আর বৃথা পরিশ্রমের ভার তোমার কাছেই নামিয়ে রেখে গেলাম।
নামিয়ে রেখে গেলাম!
নামিয়ে রেখে গেলাম।
কিন্তু কোথায় গেলাম?
সারদাপ্রসাদ যেন অবাক হয়ে ভাবে, তারপর আমি কোথায় যাব? সেই আমার প্রায় অচেনা ভাইপোদের কাছে?
তারপর যে কথাটা জীবনে কখনও মনে পড়েনি সারদাপ্রসাদের, সেই কথাটা মনে পড়ল। হয়তো পড়ত না, যদি না সরোজাক্ষ সেদিন সেই অদ্ভুত সন্দেহের কথাটা উচ্চারণ করতেন। সরোজাক্ষ সেই নোটের তাড়াটা দেখে সন্দেহ করেছিলেন সারদাপ্রসাদ তার দেশের জমিজমা বিক্রি করেছে।
সারদাপ্রসাদের তাই হঠাৎ মনে পড়ল দেশে তার জমিজমা আছে। মনে পড়ল সে জমিজমা বেচা যায়। আর বেচলে তা থেকে টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু কত সেই টাকা? সে টাকায় সারদাপ্রসাদ কোনও একটা জায়গায় নিজের মতো করে থাকতে পারে?
কিন্তু নিজের মতোটাই বা কেমন?
স্পষ্ট কোনও ধারণা করতে পারল না সারদাপ্রসাদ সেই নিজের মতোটা সম্পর্কে। সারদাপ্রসাদ আছে, অথচ তার লেখার খাতা নেই। কেমন সেই জীবন? সকাল থেকে রাত অবধি কী তবে করবে সারদা?
সারদা তো ভেবেছিল চাকরি করবে।
সাধারণ মানুষে যা করে তাই করবে। চাকরি খুঁজে খুঁজেই তো বেড়াচ্ছিল। তবে আবার সেই খোঁজার চাকরিটাই ধরুক। তারপর যখন সত্যি চাকরি জুটবে
কিন্তু জুটলেই বা কী?
কী জন্যে সেটা করবে সারদাপ্রসাদ?
শুধু নিজে কোনও একটা জায়গায় থাকবে, আর কোনওরকমে দুবেলা খাবে, এই জন্যে? সেই থাকাটা আর খাওয়াটার জন্যে সারদাপ্রসাদকে বাঁধা নিয়মে ঘুম ভেঙে উঠতে হবে, সারদাপ্রসাদকে হয়তো বাজার করতে হবে। তারপর দাড়ি কামাতে হবে, চান করতে হবে, ফরসা কাপড় জামা পরে সেজেগুজে জনতার ভিড় ঠেলে কর্মস্থলে পৌঁছতে হবে, সারাদিন খাটতে হবে?
তারপর?
তারপর আবার কী?
বাড়ি ফিরে হয়তো আবারও দোকান বাজার যেতে হবে, যার উপর রান্নার ভার, সে রান্না ফেলে। সারদাপ্রসাদের টাকার ব্যাগটা নিয়ে সরে পড়েছে কিনা খোঁজ করতে হবে, আর সেটা না করে বেঁধে সামনে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে দেখলে কৃতজ্ঞচিত্তে ভগবানকে সাতসেলাম ঠুকে খেয়েদেয়ে সকালবেলা যাতে সহজে উঠতে পারা যায়, তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
কিন্তু এসব কেন করতে হবে।
তার বিনিময়ে কী পাবে সারদাপ্রসাদ?
কী পায় লোকে?
কী আবার? ওই থাকা আর খাওয়া! ঘুরে ফিরে তো সেই একই জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছে।
অথচ ভেবে খুব একটা হাসি পাচ্ছে সারদাপ্রসাদের। শুধু ওইটুকু পাবার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ? কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত!
হয়তো নিজের কাছে নিজেকে ওই রকম আশ্চর্য আর অদ্ভুত লাগে বলেই মানুষ লোভ নামক রথের চাকায় বেঁধে ফেলে নিজেকে। অর্থলোভ, ক্ষমতার লোভ, নারীলোভ, উদ্দেশ্য সিদ্ধির লোভ, আত্মপ্রচারের লোভ। এই লোভের চাকায় নিজেকে বেঁধে ফেলে কাঁটাবনে ঘষটাতে ঘষটাতে যেতে যেতে তবে মানুষ আপন অকিঞ্চিৎকরতাটাকে ভুলে থাকতে পারে। অথবা ভুলে থাকতে চায়। নচেৎ শুধু খাওয়া শোয়ার জন্যে বেঁচে থাকাটা ভারী অর্থহীন লাগবে যে!
ওই অর্থহীন কাজটার উপর একটা ইতি টেনে দিলেই বা ক্ষতি কী?
ভাবল সারদাপ্রসাদ, গঙ্গায় তো জলের অপ্রাচুর্য নেই। আবার ভেবে লজ্জিত হল। ভাবল, ছি ছি! এ কী ভাবছি আমি! ভগবানের এই রাজ্যে মহৎ কাজের কোনও অভাব আছে?
.
মীনাক্ষী ভাবেনি, ভগবানের এই রাজ্যটা
মীনাক্ষী ভাবছিল, এত বড় পৃথিবীটায় এমন এতটুকু জায়গা নেই যে মীনাক্ষী সেখানে একটু বিশ্রাম নেয়। নিশ্চিত বিশ্রাম। যেখানে মাথা নিচু করে থাকতে হবে না। যেখানে মীনাক্ষী ভাবতে পারবে, এখানে আমি আমার মতো করে থাকব।
পৃথিবীর সেই দুর্লভ কোণটুকু ভেবে পায় না মীনাক্ষী। মীনাক্ষীর সব গোলমাল হয়ে যায়।
আমি কি তবে কাকি-ঠাকুমার আশ্রয়ে গিয়ে উঠব?
ভাবে মীনাক্ষী, অন্তত কিছুটা দিনের জন্যে?
উনি সংস্কারমুক্ত, উনি সংসারে একা, উনি লোকলজ্জার ধার ধারেন না।
কিন্তু উনি আর আসেন না।
পিসেমশাই থাকলে–তাঁকে দিয়ে বলে পাঠাতে পারতাম।
ভাবতে গেলেই চোখটা জ্বালা করে আসে মীনাক্ষীর। ভাবে পিসেমশাইকে যে আমি এত ভালবাসতাম তা তো কই কখনও বুঝতে পারিনি। পিসেমশাই দুঃখ পেয়ে চলে গেছেন ভাবলে কী ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হয়। পিসেমশাইকে ইচ্ছে করে কত দুঃখ দিয়েছি, আঘাত করেছি, অবজ্ঞা করেছি, খুব একটা কৌতুকের জায়গা ভেবে মজা করেছি।
অথচ এখন ভেবে মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কত ছোট হয়েছি তাঁর কাছে। কাউকে ছোট করতে গেলে নিজেই যে কত ছোট হয়ে যেতে হয়, সেটা বোঝা যায় সেই মানুষটা যদি বিদায় নেয়।