সরোজাক্ষ একটু সোজা হয়ে বসেন। বলেন, না, শুধু তাই ভাবতে বসব না, ভাবতে বসব কোন পদ্ধতিতে অর্থপুস্তক লিখতে পারলে অধিক অর্থ উপার্জন করতে পারব। আর ক্লাসের সময় ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রাইভেট টিউশানির জন্যে সময় বার করব।
মজুমদার অবশ্যই এ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই উত্তেজিত গলায় বলেন, আপনি তা হলে ওদেরই সমর্থন করছেন?
ভুল করছেন সুজনবাবু, আমি কাউকেই সমর্থন করছি না, আমি শুধু যা ঘটে তাই বলছি।
সুজন মজুমদার কিছু অর্থপুস্তক লিখেছেন, এবং প্রাইভেট টিউশানিও করে থাকেন তিনি, তাই আক্রমণটা তাঁর গায়ে বাজে। বাড়ি খুঁজে বাড়ি বয়ে যার হিত করতে এসেছেন, তার এই ব্যবহার!
সুজন মজুমদার উত্তেজিত গলায় বলেন, শুধু যা ঘটে তাই বলবেন কেন, উদ্দেশ্য নিয়েই বলছেন। তবে ভুলবেন না আমি আপনার হিত চেষ্টাতেই এসেছিলাম।
সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন সুজনবাবু! কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের কি আজ আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আসেনি? শুধু ছেলেদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত চিত্তে বসে তাদের সমালোচনা করাতেই কর্তব্য শেষ হবে আমাদের?
কথাগুলো শুনতে বেশ ভাল, বুঝলেন? সুজন মজুমদার উষ্ণভাবেই বলেন, সিনেমা থিয়েটারে কি গল্পে উপন্যাসে চেঁচিয়ে বলতে পারলে বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু চোখ খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন কী অবতারই হয়ে উঠেছে আমাদের ছেলেরা! কিছু না হোক, শুধু বারোয়ারি পুজোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। পুজোর স্রোত বইছে দেশে। সবাই একযোগে ভক্ত হনুমান হয়ে উঠেছেন, পুজো না করে প্রাণ বাঁচবে না। এর মধ্যেকার তত্ত্বটা কী আর তথ্যটা কী? ভেবে দেখেছেন? এই হাজার হাজার বারোয়ারি পুজোর রসদ আসছে কোথা থেকে? আসছে জুলুমবাজির মাধ্যমে। চোখ রাঙিয়ে চাঁদা আদায় করে পুজোর নামে বেপরোয়া ফুর্তি করব, এই হচ্ছে লক্ষ্য। এক-একটি পুজোর সময় দেশের চেহারা দেখলে বোঝা যাবে এ-দেশে দুঃখ আছে? দৈন্য আছে? অভাব আছে? সমস্যা আছে?
মজুমদারকে বোধ করি সম্প্রতি মোটা চাঁদার হাড়িকাঠে গলা দিতে হয়েছে, তাই এই প্রসঙ্গে আরও উদ্দীপ্ত হন। আবেগতপ্ত কণ্ঠে চালিয়েই যান, শুধু স্ফুর্তি, শুধু উল্লাস! হৃদয় বলে কিছু নেই, চিন্তা বলে কিছু নেই, মানবিকতা বলে কিছু নেই! নইলে বাংলাদেশের এক প্রান্ত যখন ক্ষয়ক্ষতি আর মৃত্যুতে শ্মশান হয়ে পড়ে আছে, অপর প্রান্তে তখন উল্লাসের উদ্দাম রোশনাই জ্বলছে।–এইসব ইয়ংদের মধ্যে সহানুভূতি থাকবে না? সমবেদনা থাকবে না? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার প্রেরণা থাকবে না? প্রেরণা আসে কীসে? না লরি চড়ে তরুণ-তরুণী মিলে সমবেতকণ্ঠে গান গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে সাহায্য সংগ্রহে। তারপর সেইসব জিনিসের গতিটা কী হল–হিসেব পাবেন না আপনি!
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, সেটাও বলতে পারা যায়, যা দেখছে তাই শিখছে।
সুজন বলেন, ওঃ বুঝেছি, ঘেরাও হয়ে পর্যন্ত আপনি এখন ওদের ভয় করে চলতে শিখছেন। আমি সে দলে নই। আমি যদি শতবার ঘেরাও হই তো দুশতবার বলব আমাদের পরবর্তী জেনারেশান স্রেফ অপদার্থ হয়ে গেছে। ওদের হয়ে বলছেন বলেই বলছি–আপনি ভাবতে পারেন আপনার ছেলেবেলায় আপনার বাবা গুরুতর পীড়িত, অথচ আপনি বারোয়ারি তলায় বসে হল্লা করছেন? আমি অন্তত ভাবতেই পারি না। আমরা ছেলেবেলায় বাড়িতে কারও শক্ত অসুখ করলে কখনও জোরে হেসে উঠতে পারতাম না। আর এখন? প্রত্যক্ষ দেখা, ছেলেরা তো বটেই, মেয়েগুলো সুষ্ঠু-এই তো আমারই বাড়ির সামনে–এক ভদ্রলোকের সিরিয়াস অসুখ, ডাক্তারে বাড়ি ভর্তি, আর তাঁর এক চোদ্দ-পনেরো বছরের ধিঙ্গি মেয়ে পুজোপ্যাণ্ডেলে রাজ্যের মেয়ে-ছেলের সঙ্গে হি হি করছে।–জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কেমন আছেন আজ?সঙ্গে সঙ্গে মুখের চেহারা করুণ করে ফেলে ন্যাকা ন্যাকা গলায় উত্তর দিল, আজ তো বাবার খুব বেশি বাড়াবাড়ি।বুঝুন এ জ্ঞান আছে খুব-বেশি-বাড়াবাড়ি। অথচ মনে এতটুকু মমতা নেই, ভয় নেই, এমনকী চক্ষুলজ্জার বালাই পর্যন্ত নেই। এই হচ্ছে এযুগের ছেলেমেয়ে, বুঝলেন? পারিবারিক বন্ধনের ধারই ধারে না।
সরোজাক্ষ যেন মনশ্চক্ষে কী দেখেন।
সে কি নিজেরই বাড়ির পারিবারিক ছবি?
কে জানে কী!
তবে উত্তর দেন, সেও আমাদেরই ত্রুটি সুজনবাবু! এই অবসরের ক মাস আমি কেবল বসে বসে ভেবেছি। অনেক ভেবেছি। আর ভেবে ভেবে দেখতে পাচ্ছি আমরা নিমের চাষ করে, আমের আশা করছি। যে কর্তব্যবুদ্ধি, যে মমতা, যে সমবেদনা ওদের কাছে আশা করছি, আমরা নিজেরা সে আদর্শ দেখাতে পারছি কই ওদের? আমরা ছেলেবেলায় কী ছিলাম ওরা সেটা দেখতে যাবে না। আমরা এখন কী হয়েছি? আমরা প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল? আমরা একে অন্যের কথা ভাবি? বেশি কথা কী, একই বাড়িতে একজন আর একজনকে বুঝি না, একজন অপরজনকে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে বসি। তবে?
তবে আর কী? হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভাসাই শ্রেয় হবে। বিদ্রুপের গলায় কথাটা বলে সুজন মজুমদার দাঁড়িয়ে উঠে বলেন,আচ্ছা, আপনার মতামত জানাবেন পরে।
পরে জানাবার কিছু নেই সুজনবাবু, সরোজা বলেন, আমি মনঃস্থির করে ফেলেছি হুগলি কলেজেই জয়েন করব। আপনার সহানুভূতির জন্যে ধন্যবাদ!
সুজন মজুমদার নমস্কার করে বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, চিন্তা করছ। হরদম চিন্তা করছ। তার মানে, তোমার হেড কোম্পানিতে গণ্ডগোল বেধেছে।