মীনাক্ষী যে তার দাদার সঙ্গে এমন খোলাখুলি কথা বলতে পারবে, একথা কবে ভেবেছিল মীনাক্ষী? অথচ পারল। মানুষ যখন কোনও একটা সংকল্পে স্থির হয়, তখন বোধ করি তার এমনি করেই সাহস আসে। আর তখন তার সেই সাহসকে অপরের সমীহ না করে উপায় থাকে না।
নীলাক্ষও করল সমীহ।
পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তা হলে তুমি কী করবে ঠিক করছ?
অহরহ সেটাই ভাবছি।
নীলাক্ষ একটু ইতস্তত করে বলে ওঠে, ময়ূর বলছিল অথচ অতি সহজেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
মীনাক্ষী তার দাদার মুখের দিকে চেয়ে দেখে। সেখানে হিতৈষী বড়ভাইয়ের ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। মীনাক্ষী অবাক হয়। দাদাকে মীনাক্ষী হৃদয়হীন বলেই জেনে এসেছে এতদিন। ভেবে এসেছে দাদা পারিবারিক বন্ধনহীন। অথচ দাদা তার ছোট বোনের জন্যে ভাবছে, ব্যাকুল হচ্ছে। তবে হয়তো ওর ওই বন্ধনহীনতার জন্যে এই পরিবারের পরিবেশই দায়ী। চিরদিন মা আছেন তাঁর কল্পিত স্বর্গের সিংহাসনে, বাবা তাঁর অহংকারের গজদন্তমিনারে, আমরা অবাঞ্ছিত, আমরা অবান্তর। তাই আমরাও স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠেছি। আমরা ভাইবোনে পরস্পরকে ভাল না বেসে সমালোচনা করতে শিখেছি। তবু তার মধ্যে থেকেও দাদা আমার জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছে, ব্যথিত হচ্ছে।
মীনাক্ষীর চোখের কোণটা ভিজে এল, মীনাক্ষী মাথা নামিয়ে বলল,শুধু দিদি কেন, মা-ও সে সমাধানের নির্দেশ দিতে এসেছিলেন দাদা, কিন্তু একজনের কাছে যা সহজ, অন্যের কাছে তা সহজ নাও হতে পারে। অপরাধ করে তার দণ্ড ফাঁকি দেব, এ আমি ভাবতে পারছি না। তবু তোমাদের আর বেশিদিন বিপদে ফেলে রাখব না—
বিপদে ফেলে রাখবি না! নীলাক্ষ ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে, কী করবি তবে? কী তোর মতলব? সুইসাইড করতে চাস বুঝি?
মীনাক্ষী মুখ তোলে।
মীনাক্ষী মৃদু হাসে।
বলে, না দাদা! সেও তো দণ্ড এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়াই। আর তেমন মতি হলে এতদিন ধরে এত ভেবে মরবই বা কেন?
নীলাক্ষ আর একবার পায়চারি করে ঘরটা ঘুরে নেয়। তারপর মীনাক্ষীর খুব কাছে এসে তাড়াতাড়ি বলে,জানি না কী তুই ভেবে ঠিক করছিস। আমি তো ফরনাথিং এত কষ্ট পাবার কোনও মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। তুচ্ছ একটা সেন্টিমেন্টের জন্যে জীবনটাকে জটিল করে তোলার মধ্যে কী যুক্তি আছে তোদের ভগবানই জানে। যাক–যাই ভাবিস, আর যাই ঠিক করিস, টাকা-ফাঁকার দরকার হলে বলতে লজ্জা পাস নে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মীনাক্ষী ওর চলে যাবার পথের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। দাদার হৃদয়ে যে তার জন্যে এতটা স্নেহ ছিল তা কবে জেনেছে মীনাক্ষী?
কিন্তু ছিল সেকথা কি নীলাক্ষ নিজেই জানত? নীলাক্ষ সর্বদাই মনকেঠিক দিত, এ সংসারের কেউ আমার নয়, আমি কারও নই, ব্যস।
অথচ ও ওর ছোটবোনের জন্যে খুব একটা কষ্ট বোধ করছে। ও ওর ছোটবোনের হাতে নিজের চেক বই তুলে দিতে চাইছে।
.
হয়তো এমনিই হয়।
তাই বিজয়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পরদা ঝোলানোনা একটা দরজার দিকে তাকাতে পারেন না। বিজয়ার অহরহ মনে পড়তে থাকে–একটা শিশুর মতো মানুষ শুধু খেতে থাকতে বলে বিজয়া তাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতেন, বিজয়া তার উচ্ছেদ কামনায় পুজো মানত করতেন। ওই একটা ঘর বরবাদ হয়ে আছে বলে রাগের শেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু কই, ঘরটায় ঢুকে পড়ে পুরনো চিহ্ন ধুয়ে মুছে ফেলে কাজে লাগাবার কথা ভাবতেও পারা যাচ্ছে না কেন?
.
সরোজাক্ষর ছেড়ে আসা কলেজ থেকে সহকর্মী ডক্টর মজুমদার এলেন একদিন সরোজাক্ষর বাড়ি খুঁজে।
তা বাড়ি খুঁজেই।
সরোজাক্ষ আর কবে তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে বাড়ি চিনিয়েছেন?
কদাচ না।
ছেলেমেয়ের বিয়েতেও না।
নিজের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কর্মজগতে তিনি একেবারে নীরব ছিলেন। কেউ কোনও প্রশ্ন করলেও যতটা সম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে সারতেন।
অতএব সুজন মজুমদারকে বাড়ি খোঁজার কাজটাই করতে হল।
এলেন তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের দূত হয়ে। তাঁরা আবার ডাকছেন।
সরোজাক্ষ যখন পুনর্বার কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, পদত্যাগ করে আমি ভুল করেছি ঠিক সেই মুহূর্তেই তাঁকে কেন নেওয়া সম্ভব হয়নি তার কারণ দর্শে এবং অনুতাপ প্রকাশ করে অনুরোধ জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, সরোজাক্ষ যেন আবার নিজ জায়গায় ফিরে আসেন।
সরোজাক্ষ এ সংবাদে উৎফুল্ল হলেন কি বিব্রত হলেন, কিছুই বোঝা গেল না। নির্লিপ্ত গলায় বললেন, রয়েছেন তো একজন?
মজুমদার হেসে বলেন, রয়েছেন, কিন্তু না থাকাতে কতক্ষণ? একযোগে সবাই মিলে একবার অনাস্থা প্রস্তাব তুললেই
সরোজাক্ষ প্রায় অবাক গলায় বলেন, কিন্তু কেন?
কেন আর? মজুমদার অনিবার্যের গলায় বলেন, ওঁর পড়ানো ছেলেদের ভাল লাগছে না।
আমার পড়ানো ভাল লাগত?
কী আশ্চর্য! এটা কি আর নতুন করে জিজ্ঞেস করবার কথা?
কিন্তু এটা বোধহয় আপনার ভুল ধারণা সুজনবাবু, সরোজাক্ষ বলেন, তা হলে একজন ছাত্রও কোনওদিন আমার কাছে এসে আক্ষেপ প্রকাশ করত।
এসে আক্ষেপ প্রকাশ করবে! মনের ভাব গোপনে অপটু সুজন মজুমদার ব্যঙ্গ হাসি হেসে ওঠেন, তা হলেই হয়েছে। ওদের কাছে আমাদের অত আশা করবার কিছু নেই সরোজবাবু! দয়া করে যার ক্লাসে শেয়াল ডাক ডাকবে না, ধরে নিতে হবে তাকে কিঞ্চিৎ পছন্দ করছে। কিছু ছেলে অবশ্য আছে যারা সভ্য ভদ্র বিনয়ী, কিন্তু ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ভয়ে তারাও ক্রমশ মস্তান হয়ে ওঠে। আপনি বরাবরই সাতে-পাঁচে কম থাকেন তাই অতটা লক্ষ করেন না। ভদ্রঘরের ছেলেদের মুখের ভাষা কী হয়েছে যদি শোনেন! বন্ধুতে বন্ধুতে আড্ডা দিচ্ছে, আদরের সম্বোধন হল, শালা মাইরি! কানে এলে কান গরম হয়ে ওঠে। আমরা বরাবর জানতাম মশাই, ওসব হল ইতরের ভাষা। এখন শুনছি ওটাই নাকি বাহাদুরি। একটামাত্র তুচ্ছ নমুনাই শোনালাম আপনাকে, সব কথা আপনার নার্ভ বরদাস্ত করতে পারবে না, তাই বলছি না। মজুমদার একবার দম নিয়ে বলেন, বলা হয়–শিক্ষাই সুরুচির বাহন, তা দেশে শিক্ষার প্রসার যত বাড়ছে, রুচির বালাই তো ততই দুরে সরে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার আশ্রয় কলেজগুলোকেই তো মাপকাঠি বলে ধরতে হবে? তা দেখুন তাকিয়ে। সর্বত্রই দেখুন। স্টুডেন্ট মহলে এখন মদ না খাওয়াটা গাঁইয়ামি, মার্জিত ভাষায় কথা বলাটা বুড়োমি, আর দু-পাঁচটা করে গার্ল ফ্রেন্ড না থাকাটা বুষ্টুমি। এইসব ছেলেরাই ওই উচ্চশিক্ষার জোরে দেশের দপ্তরে দপ্তরে ছড়িয়ে পড়বে, উঁচু পোস্টে গিয়ে বসবে। আর আমরা নির্বোধের মতো ভাবতে বসব দেশের সমস্যা দূর হবে কোন পথে?