ধৈর্য ধরবার ক্ষমতা বিজয়ার নেই, সবুরে মেওয়া ফলে এ বিশ্বাসও নেই। তাই মেয়েটার উপর নিজের চিন্তাভারের খানিকটা চাপিয়ে দিয়ে যেন কিঞ্চিৎ হালকা হলেন।
ময়ূরাক্ষীও আবার হালকা হতে চাইল দাদার উপর চাপিয়ে।
নীলাক্ষ অবশ্য ওর মতো প্রত্যেকটি খবরকেই গুরুত্ব দিল না। বাবা কলকাতার কাজ ছেড়ে হুগলি কলেজের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এটা কী আর এমন মন্দ?
বাড়ি বসে বসে ফসিল হচ্ছিলেন, যান না বাইরে।
সারদাপ্রসাদের চলে যাওয়া?
সেটাতেও আপাতত নিজের কাছে নিজেকে ঈষৎ অপ্রতিভ অপ্রতিভ লাগলেও, খবরটা সুখবরই, কিন্তু মীনাক্ষী?
সংসার সম্পর্কে দায়িত্ব এবং মমত্বলেশহীন নীলাক্ষও শুনে হঠাৎ আঘাত খেয়ে জেগে ওঠা বাঘের মতো গর্জে উঠে বলেছিল, অসম্ভব।
কিন্তু অসম্ভববলে হুঙ্কার দিলেই তো হল না? ময়ূরাক্ষী তো নিজের ঘর থেকে গল্পটা বানিয়ে এনে দাদাকে শোনাতে বসেনি? বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞেস করুক সে।
মাকে জিজ্ঞেস না করে স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করল,জানতে তুমি?
সুনন্দা গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
আমায় বলোনি যে?
বললে কী করতে?
কী করতাম?
নীলাক্ষ গজরাতে গজরাতে বলে, সেই হতভাগা রাস্কেলটাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতাম।
ওঃ বাধ্য করতে? কিন্তু বাধ্য করে বিয়েয় যদি তোমার বোনের মন না থাকে?
মন না থাকে? মন না থাকে? ইয়ার্কি নাকি? মন কী করে করাতে হয় দেখাচ্ছি গিয়ে।
সুনন্দা দৃঢ়স্বরে বলে, পাগলামি কোরো না। তোমাদের হিসেবনিকেশের ধারায় চলবার মেয়ে ও নয়।
নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, শুধু ও কেন, জগতের কোন মেয়েমানুষটাই বা সহজে ন্যায্য হিসেবনিকেশের ধারায় চলতে চায়? এক নম্বরের পাজি জাত।
সুনন্দা উত্তর দেয় না, শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। নীলাক্ষ তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠে, বেশ তো, বিয়ে করতে রাজি না হয়, তার নাম-ঠিকানাটা বলুক, চাবকে ছাল ছাড়িয়ে দিয়ে আসি রাস্কেলটার।
তা হলে তো খুবই ভাল হয়–সুনন্দা ভালমানুষের গলায় বলে, ছুরিটা শানিয়ে ফেলো ততক্ষণ।
নীলাক্ষ ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে, রাবিশ! তারপর মীনাক্ষীর ঘরে গটগটিয়ে ঢুকে এসে বিনা ভূমিকায় বলে ওঠে, এই মীনা, সেই রাস্কেলটার নাম-ঠিকানা কী?
.
মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদাকে মুখোমুখি দেখল। মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদার দিকে তাকাল। তারপর বলল, নাম-ঠিকানা জেনে তোমার কোনও লাভ হবে না দাদা!
লাভ-লোকসান আমি বুঝব,নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, নাম-ঠিকানাটা আমার জানা দরকার।
দরকার নেই দাদা!
দরকার নেই মানে? আমি তাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতে চাই।
মীনাক্ষী ওর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে এভাবে এমন স্পষ্ট করে কথা বলতে হবে ভাবিনি দাদা! ভয় ছিল হয়তো বাবার দরবারে-যা বলছিই যখন, তখন বলি, বাধ্য করানো বিয়েতে তোমার আস্থা আছে?
আস্থা? আস্থা মানে? কীসের আস্থা?
মানে সেটা সুখের হবে বলে তোমার ধারণা?
সুখের।
নীলার মুখে হঠাৎ একটা উদাস দার্শনিক হাসি ফুটে ওঠে, বাধ্য করে ছাড়া অন্য সব বিয়েই সুখের হয়, এই তোর ধারণা?
মীনাক্ষী স্থির গলায় বলে, তবু তার মধ্যে অন্তত সম্ভ্রম আছে।
সম্ভ্রম! ওঃ!
নীলাক্ষ আরও সূক্ষ্ম একটু হাসে, সম্ভ্রম কথাটার মানে তো দূরে থাক, বানানই জানা নেই মীনা! জানি না কাদের জানা আছে।
এটা তুমি কী বলছ দাদা।
ঠিকই বলছি মীনা। নীলাক্ষ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলে, সম্ভ্রম আমাদের কোথায়? সমবোধই বা কোথায়? সমাজের উঁচু চুড়োয় ওঠবার জন্যে আমরা নীচতার পাতালে নামতেও প্রস্তুত, সম্ভ্রমের সিংহাসনে বসবার টিকিট সংগ্রহ করতে অসম্ভ্রমের নরকে যেতেও পিছপা নই। সবাই সবাইয়ের আসল মুখের চেহারা জানে, তবু আমরা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াই, আর ভাবি আমি কী সম্ভ্রান্ত! এবং যদি কেউ সে মুখোশ খুলে নিজের সত্যি মুখ দেখাতে চায়, তাকে সবাই ছি ছি করে উঠি। কোনও ক্ষেত্রেই তো কেউ কাউকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি না। তবে আর ও শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ?
মীনাক্ষী মৃদুগলায় বলে,অন্যের চোখে সম্ভ্রান্ত হওয়ার কথা বলিনি আমি দাদা, প্রশ্নটা আত্মসম্ভ্রমের।
নীলাক্ষ ওর ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। নীলাক্ষ যেন অবাক হয়ে যায়। ওর হঠাৎ মনে হয়, ছোটরা কোন ফাঁকে সহসা বড় হয়ে ওঠে। আমি ভাবছিলাম আমি ওর ভার নেব। ও নির্বোধ, ও অসহায়, ও আমার ছোট বোন, আমি ওর সহায় হব। দেখছি কখন ও বড় হয়ে গেছে। ওর আর কারও সাহায্যের দরকার নেই। ও নিজের ভুল নিজেই শোধরাতে চায়। এখানে তবে আমার আর কী করার আছে?
তবু নিজের পূর্ব চিন্তার জের টেনে বলল নীলাক্ষ, বেশ,–বিয়েতে তোর আপত্তি থাকে, ঠিকানা পেলে তাকে চাবকে আসতেও পারি।
তাতেই বা সম্মান কোথায় দাদা?
বেশ! চমৎকার! তুমি তোমার ওই এক ফস্ সম্মান আর সমবোধ নিয়ে ধুয়ে জল খাও, আর একটা বদমাইশ যা ইচ্ছে অন্যায় করে পার পেয়ে যাক, কেমন?
মীনার চোখটা এবার নেমে এসেছিল, মীনা আর দাদার মুখোমুখি তাকাতে পারছিল না, তবু আস্তে বলল, সব অন্যায়ের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর মধ্যে স্বস্তি থাকতে পারে দাদা, সত্য নেই। অন্যায় কি আমারই নেই? আমি দুঃসাহস করেছি, আমি যাকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করেছি, তাকেই বিশ্বাসের ভান করেছি, আমি মার অবাধ্য হয়েছি, আর–আর আমি আমার পারিবারিক মর্যাদার কথা না ভেবে লুকিয়ে একটা বাজে ছেলের সঙ্গে মিশেছি। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে আমি ভুল করছি–তবু মোহগ্রস্ত হয়ে ভেবেছি ওই মনে হওয়াটা কুসংস্কার, ওর প্রভাবমুক্ত হতে পারাটাই আধুনিকতা। তার একটা মাশুল দিতে হবে বইকী!